সন্ধ্যাবেলা গঙ্গায় স্নান সেরে ঘাটে গিয়ে বসেছিলেন কৃষ্ণনাথ কলেজের এক আবাসিক ছাত্র। চুপ করে নিজের মনে বসে রয়েছেন। কিন্তু বুঝতে পারেননি, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ সুপারের খাস ভৃত্য এক ভিস্তিওয়ালার যাতায়াতের পথেই বসে রয়েছেন তিনি। সাহেবের প্রতাপের প্রভাবে ভিস্তিওয়ালারও প্রতাপ কম নয়। যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ দেখে অবলীলাক্রমে সে জল ঢেলে দিল ওই ছাত্রের গায়ে। প্রতিবাদ করলেন ওই ছাত্র। তখন জুটল বেধড়ক মারধর। খাস পুলিশ সুপারের ভিস্তিওয়ালা বলে কথা!
কিন্তু ছাত্রেরা কেন সে কথা শুনবে! মারধরের কথা ছড়িয়ে পড়তেই ভিস্তিওয়ালার খোঁজ শুরু হল। কলেজের ছাত্রেরা সোজা গিয়ে চড়াও হল খোদ পুলিশ সুপার ডিকেন্স সাহেবের কুঠিতেই। তিনিও সোজা আজ্ঞা দিয়ে দিলেন, সব ছাত্রকে গ্রেফতার করতে হবে। সেই নির্দেশ কানে গেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এডওয়ার্ড মনমোহিনী হুইলারের। তারপরের ঘটনা এখনও বহরমপুরের প্রবীণ বাসিন্দারা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করেন। হুইলার ছাত্রাবাসে ছুটে তো এলেনই। ছাত্রাবাসের বারান্দা থেকে পুলিশ অফিসারকে ঘাড় ধরে বারও করে দিলেন। তারপরে সেই অফিসারকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার সাহেবকে গিয়ে বোলো ডিকেন্স এবং ডাঙ্কি, দু’টো শব্দেরই প্রথম অক্ষরটা ডি।’
সামনেই মুর্শিদাবাদের ১৫টি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন। নানা কলেজে ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছে। ঘেরাও হয়েছেন অধ্যক্ষেরা। পুলিশ-প্রশাসনকে বারবার ছুটে যেতে হয়েছে বিদ্যায়তনে। অথচ এই সেই জেলা, যেখানে হুইলারের মতো অধ্যক্ষেরা দু’হাতে সন্তান স্নেহে আগলে রাখতেন ছাত্রদের। ছাত্রেরাও মাস্টারমশায়দের সম্মান করতেন অগ্রজ স্বজনদের মতোই।
কৃষ্ণনাথ কলেজের কিংবদন্তী অধ্যক্ষ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের নাতি ই এম হুইলার বা হুইলার সাহেব ১৯০৬ সালে কলেজের দায়িত্ব নেন। পরিশ্রমী, ছাত্রদরদী, ক্রীড়াপ্রেমী ও সুপণ্ডিত মানুষটি সপ্তাহে ২৬টি ক্লাস নিতেন। কবিশেখর কালিদাস রায় ছিলেন হুইলার সাহেবের ছাত্র। ‘আচার্য রেভারেন্ড হুইলার’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “ছাত্রাবাসে কোনও ছাত্র অসুস্থ হইলে তিনি দু’বেলা তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাহার ব্যাধির অবস্থা সম্বন্ধে সন্ধান লইতেন। ছাত্র যদি বলিত তাহার মাথার যন্ত্রণা হইতেছে, তাহা হইলে নিজ হাতে তাহার মাথা টিপিয়া দিতেন, গায়ে হাত বুলাইয়া দিতেন ও শুশ্রূষা করিতেন।” এফ এ পরীক্ষা দেওয়ার সময় কবির বুকে ব্যথা শুরু হয়। কবি লিখেছেন, “এক হাতে বুক চাপিয়া ধরিয়া অন্য হাতে লিখিতেছিলাম। মুখে আমার ক্লেশের চিহ্ন।” তাই দেখে হুইলার গিয়ে তাঁর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছিলেন। এবং সেখানেই দায়িত্ব শেষ করে ফেলেননি। কবিশেখর জানাচ্ছেন, ‘‘পর দিন দশটার সময়ে আসিয়া আমার খোঁজ লইলেন। ভাল আছি জানিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া চলিয়া গেলেন।”
শিক্ষক যদি এমন হন, তা হলে ছাত্রেরাও তাঁর সন্তানের মতোই হয়ে যায়। হুইলার তাঁর প্রাক্তন ছাত্র কৌশিকনাথ ভট্টাচার্যের কান ধরেছিলেন এক মাঠ লোকের সামনে। কৌশিকনাথ তখন রাজশাহি কলেজের শিক্ষক। তিনি স্মৃতিকথায় লিখছেন, “রাজশাহি কলেজের সঙ্গে কৃষ্ণনাথ কলেজের ফুটবল ম্যাচ। হাফ টাইমের সময় খেলোয়াড় হুইলার সাহেব সবার সামনে আমার দু’কান মলে দিয়ে বললেন, ‘স্টিমারঘাটে আমাদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, যাওনি কেন?’ ক্ষমা চেয়ে বললাম, ‘তখন আমি কলেজে ছাত্রদের পড়াতে ব্যস্ত ছিলাম।’’ ব্যাস। ওই একটি কথাতেই হুইলার খুশি। (চলবে) |