ঘটনার পর তিন দিন কেটে গিয়েছে। এখনও একটানা বেশি ক্ষণ কথা বলতে পারেন না তিনি। দম আটকে আসে। কাশির দমকে হাঁপিয়ে ওঠেন।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকুরিয়া আমরির নিউরোলজি বিভাগের দুই রোগীকে কোনওমতে বাইরে বার করতে পারলেও নিজে বেরোতে পারছিলেন না হাসপাতালের নার্স অসীমা হালদার। কার্নিসেই দাঁড়িয়েছিলেন কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। বেশ কিছু ক্ষণ ওই জতুগৃহে আটকে থাকার পরে দমকলকর্মীরা ২৪ বছরের অসীমাকে নামিয়ে আনেন। এর পর থেকেই অসুস্থ তিনি।
অসীমাই পঞ্চাননতলা বস্তির একমাত্র বাসিন্দা, যিনি ওই হাসপাতালে নার্সের কাজ করতেন। উদ্ধারের পরে তাঁকে ওই হাসপাতালেরই পুরনো বিল্ডিংয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। অক্সিজেন, স্যালাইন আর প্রচুর ইঞ্জেকশনে খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পরে শনিবার তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এখন কেমন আছেন তিনি?
অসীমা হালদার |
বস্তিতে তাঁদের ছোট্ট ঘুপচি ঘরটায় একটা তক্তপোশ পাতার পর দু’জন মানুষও ভাল করে দাঁড়াতে পারেন না। ওইটুকু ফাঁকা জায়গার মধ্যেই আবার একটা মই খাড়া করে রাখা। সেই মই দিয়েই উপরে উঠলে একটা ঘুপচি ঘর। সোমবার দুপুরে সেখানেই শুয়েছিলেন তিনি। ডাকাডাকির পর মই ধরে নীচে নেমে জানালেন, এত ক্লান্তি ও অসুস্থতার মধ্যেও ঘুম আসছে না কিছুতেই। চোখ বুজলেই কানে বাজছে অসহায় কিছু মানুষের আর্তনাদ। অসীমা বলেন, “হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও বুকে ব্যথা হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। ওষুধও চলছে।”
সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠছেন অসীমা। তিনি জানান, চার তলায় নিউরোলজি ওয়ার্ডে ডিউটি ছিল। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ পাশের ওয়ার্ডের এক জন নার্স এসে আগুন লাগার কথা জানান। প্রথমে কী করবেন বুঝতে না পেরে বাড়িতে দিদিকে ফোন করেন তিনি। তার পর? অসীমার কথায়, “হঠাৎ দেখলাম ঘরের এসি মেশিন থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কোনও এক জন সব আলো নিভিয়ে দিয়েছিলেন। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোতেই টের পেলাম করিডরেও কালো ধোঁয়া। সবাই ছোটাছুটি করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল।”
ওই বিপদের মধ্যেও নিজের কর্তব্য ভোলেননি তিনি। কোনওমতে ঢুকে পড়েন একটি কেবিনে। দুই রোগিনীকে বিছানা থেকে নামিয়ে হাত ধরে নিয়ে যান পিছনের সিঁড়ির দিকে। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে সেই আলোতেই সামনের পথটুকু বুঝিয়ে দেন তাঁদের। তার পরে অন্য কেবিনগুলোয় ঢোকার চেষ্টা করতেই প্রবল কাশি শুরু হয় তাঁর। কোনওমতে চারতলার করিডরের ধার ঘেঁষে একটা জানলার পাশে চলে আসেন।
অসীমা বলেন, “ওই জানলার কাছেই দাঁড়িয়েছিল সন্ধ্যা নামে আর এক জন নার্স। জানলার মোটা কাচ ভাঙতে সামনে পড়ে থাকা একটা চেয়ার নিলাম। সেটা দিয়ে জানলার কাচে পাগলের মতো মারছিলাম দু’জনে। পাঁচ ছ’বার ঘা দেওয়ার পরে দু’টো জানলার কাচ ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল। ওই জানলা দিয়ে দু’জনে নেমে পড়লাম কার্নিসে।”
চারতলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরছিল অসীমার। নীচে তখন প্রচুর মানুষের ভিড়। কিন্তু চিৎকার করেও কারও সাড়া মিলছে না। অসীমা বলেন, “এক সময় মনে হচ্ছিল সময় যেন আর কাটছে না। বাঁচার জন্য নীচে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।” সেই সময়ে ওই জানলার কাছে পৌঁছয় দমকলের একটা মই। ওই মইয়ে এক জন দমকল কর্মীকেও দেখতে পান অসীমা। “জানলার কার্নিসে পা ঝুলিয়ে বসে মইয়ের সিঁড়িতে পা দিতেই টলে যাই। আমার হাতটা কোনও রকমে ধরে ফেলেন ওই দমকলকর্মী। তার পর আর কিছু মনে নেই”, বললেন অসীমা। জ্ঞান ফেরার পরে প্রথমেই সন্ধ্যার খোঁজ করেন। জানতে পারেন, তাঁকেও নিরাপদেই নীচে নামানো হয়েছে।
হাসপাতালের অধিকাংশ মানুষই যখন নিজে বাঁচার চেষ্টা করছেন, তখন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সম্পূর্ণ অনাত্মীয় দুই মহিলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এখন সে কথা ভেবে ভয় করছে না? অসীমা বলেন, “ভয় নয়, আফশোস হচ্ছে। আর একটু আগে যদি আগুন লাগার কথা টের পেতাম, হয়তো আরও কয়েক জনকে বাঁচাতে পারতাম।”
দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক ভাই ও মা বাবার সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী। বাবা অসুস্থ, ভাই এখনও পর্যন্ত
সে রকম কিছু করেন না। জুনিয়র নার্স হিসাবে তিনি বেতন পান
হাজার পাঁচেক টাকা। এখন অনিশ্চিত ওই টাকাটুকুও।
অসীমা বলেন, “হাসপাতালের অনেক বিভাগই তো পুড়ে গিয়েছে। আমাদের চাকরির কাগজপত্রও সব নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জানি না, এর পর কী হবে।” |