চোর পালিয়েছে। এ বার বুদ্ধি বাড়াতে নেমে পড়ল রাজ্য সরকার। যে জাতীয় গৃহনির্মাণ বিধি বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (এনবিসি) এত দিন ধরে মানা হয়নি, তার ভিত্তিতে একটি নতুন আইন করার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কমিটি গড়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বস্তুত, আগুন লাগার ঝুঁকি আছে, এমন যে কোনও বাড়ি বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত বহুতলের জন্য জাতীয় গৃহনির্মাণ বিধি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা আমরি-কাণ্ডের পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার এই লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন দফতরকে নিয়ে কমিটি-টি গড়েন তিনি। রাজ্যে বহুতলগুলিতে বিপদ এড়ানোর জন্য আবশ্যিক বিধিগুলি যে এত দিন ধরে অবহেলিতই থেকে গিয়েছে, তা রাজ্য প্রশাসনের মাথারাই এখন মানছেন। তা থেকে রেহাই পেতে মমতা চান, রাজ্যে এনবিসি কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা হোক।
তাঁর সরকারের ২০০ দিনের কাজের পর্যালোচনায় এ দিন টাউন হলে মন্ত্রী-আমলাদের একটি বৈঠক ডেকেছিলেন মমতা। সেখানে আমরি-কাণ্ডের জেরে রাজ্যে যে এনবিসি কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা দরকার, সেই বিষয়টি জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বিদ্যুৎ, দমকল, পুলিশ, পূর্ত, নগরোন্নয়ন ও বিপর্যয় মোকাবিলা-সহ বিভিন্ন দফতরের কর্তাদের নিয়ে রাজ্য সরকার তৈরি করতে চলেছে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। তার মাথায় থাকবেন কলকাতা পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত ডিজি (বিল্ডিং) অশোক রায়চৌধুরী। ওই কমিটি এনবিসি-র সুপারিশ মেনে রাজ্যে গৃহনির্মাণে নতুন আইন তৈরি করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। |
আমরির অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে
আয়োজিত স্মরণসভায় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুমন বল্লভ |
টাউন হলের বৈঠকে যাওয়ার আগে মহাকরণে মমতা জানিয়ে দিয়েছিলেন, “রাজ্যে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড আরও কঠোর ভাবে বলবৎ করব। কী ভাবে কী করা যায়, সেটা আইনের বিধিগুলি দেখে আমরা শীঘ্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি।” আর মুখ্যমন্ত্রী কী করতে চাইছেন, বৈঠকের পরে তা পরিষ্কার করে দেন পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, “কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডিজি (বিল্ডিং) অশোক রায়চৌধুরীকে মাথায় রেখে একটি কমিটি গড়ছি আমরা। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-এর সুপারিশগুলির ভিত্তিতেই কমিটি তাদের সুপারিশ তৈরি করবে। এবং তারই ভিত্তিতে রাজ্যের জন্য উপযুক্ত আইন তৈরি হবে।”
শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় রুখতে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে এ দিন আরও একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারা বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয় রোধ করা নিয়ে রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দেবে। দমকল এবং পুরসভার গৃহনির্মাণ আইনের কোনও সংশোধন বা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা-ও ওই কমিটি ঠিক করবে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর।
এত দিন রাজ্যে কেন মানা হয়নি এনবিসি? দমকল কর্তারা বলছেন, বাম-জমানায় ১৯৯৬ সালে দমকল আইনেও এনবিসি-র সুপারিশই মানার কথা বলা হয়েছিল। তার আগে কোনও বাড়ির ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে দমকলের ভূমিকা থাকত না। এনবিসি-র সুপারিশ কতটা মানা হয়েছে, তার ভিত্তিতেই ১৯৯৬ সালের পরে নির্মিত বাড়িগুলির ছাড়পত্র দেওয়া শুরু করে দমকল। কিন্তু বাস্তবে, এনবিসি-র সুপারিশ কতটা মানা হবে আর কতটা হবে না, তা নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা থেকে যাওয়ায় কার্যত কিছুই করা যায়নি বলে মানছেন দমকলের কর্তারাই।
তাঁরা বলছেন, ১৯৯৬ সালের আগে নির্মিত বাড়িগুলির ক্ষেত্রে এনবিসি-র সুপারিশ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালের পরে নির্মিত বাড়িগুলির ক্ষেত্রেও এনবিসি-র সুপারিশ মানায় ছাড় দেওয়াটাই প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে দমকল-কর্তাদের অভিযোগ। এনবিসি-তে হাসপাতালে রোগীদের বার করতে র্যাম্প বা ঢালের কথা বলা হলেও বাস্তবে, তার প্রয়োগ ছাড়াই অনুমোদন পেয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল। দমকলও লাইসেন্স দিয়েছে। পুরসভা দিয়েছে ট্রেড লাইসেন্স।
|
ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড আরও কঠোর ভাবে বলবৎ করব।
কী ভাবে কী করা যায় সেটা বিধি দেখে ঠিক করব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী |
|
|
ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে রাজ্যেও বিধি তৈরি হচ্ছে। এর জন্য বিদ্যুৎ, দমকল, পূর্ত, স্বরাষ্ট্র, নগরোন্নয়ন ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরকে নিয়ে কমিটি হবে।
ফিরহাদ হাকিম
পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী |
|
|
যুগ্ম কমিশনার (অর্গানাইজেশন)-এর নেতৃত্বে কমিটি গড়ে লালবাজারের ক্ষেত্রেও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড খতিয়ে দেখব।
রঞ্জিতকুমার পচনন্দা পুলিশ কমিশনার |
|
|
দমকলের অতিরিক্ত ডিজি দেবপ্রিয় বিশ্বাস এ দিন বলেন, “দমকল আইনে আগুনের বিপদ নিয়ে কারও বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ আনা হলে কিন্তু
এনবিসি-র সুপারিশ লঙ্ঘন করার দিকগুলিই প্রথমে দেখা হয়।” ১৯৯৬ সালের পরে তৈরি বাড়িগুলির ক্ষেত্রে কোনও বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটার পরেই এই অভিযোগে মামলা রুজু করেছে দমকল। দমকলের এক কর্তার কথায়, “বাস্তবে, বই (পড়ুন ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) আমাদের হাতের কাছেই ছিল। অনেকে বইটা পড়েওছেন। কিন্তু বইয়ের শিক্ষাটা মানতেই খামতি থেকে যায়। এই কোড প্রয়োগে কোনও কড়া আইন হলে আখেরে সবারই লাভ।”
তবে নতুন বাড়িগুলিকে এনবিসি-র আওতায় আনা গেলেও পুরনো বাড়িগুলিকে নিয়ে সমস্যা কী ভাবে দূর হবে, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। পূর্তসচিব এ কে বর্ধন বলেন, “জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে গেলে আমাদের দেখতে হবে, তাতে পুরনো বাড়ি সম্পর্কে কী কী বলা হয়েছে। এটা সময় সাপেক্ষ পদ্ধতি। নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে আমরা আইনমতো ব্যবস্থা নিতেই পারি। কিন্তু পুরনো বাড়ি নিয়েই সমস্যা।
কলকাতা পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং) দেবাশিস কর আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন এনবিসি মানা হলেও মাথায় রাখতে হবে, সব রাজ্যের বাস্তবতা এক নয়। তাঁর কথায়, “এ ধরনের একটি গাইডলাইন বা নির্দেশিকা রয়েছে। সেটা আমরা মেনে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু সারা দেশের জন্য প্রযোজ্য কোনও জাতীয় নিয়ম নেই। কারণ, রাজ্যে রাজ্যে জলবায়ুর ভিত্তিতে বাড়ির নকশা তৈরি হয়।”
কলকাতা পুলিশও তাদের সুপারিশে এনবিসি-র নির্দেশিকা মেনে চলার পক্ষপাতী। বহু বছর আগে নির্মিত হলেও লালবাজারের ভবনটির সুরক্ষার জন্যও এনবিসি-র কিছু পরামর্শ কাজে লাগতে পারে বলে মনে করেন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আমরা লালবাজারের ক্ষেত্রে এনবিসি খতিয়ে দেখব। যুগ্ম কমিশনার (অর্গাাইজেশন)-কে দিয়ে একটি কমিটি গড়ব। সেই কমিটি পূর্ত দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের সুপারিশ ও পরামর্শ মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করবে।” |