ডারবান প্ল্যাটফর্ম’ হইতে ভবিষ্যতের দিকে যে ট্রেন ছাড়িবে, ভারতের কি তাহাতে সওয়ার হওয়া উচিত? রাষ্ট্রপুঞ্জের সপ্তদশ জলবায়ু সম্মেলন শেষ হইবার পরে একশত একুশ কোটি মানুষের নিকট ইহাই সর্বাধিক গুরুত্বের প্রশ্ন হওয়ার কথা। কারণ, এই প্রশ্নটির উত্তরের উপরে তাহাদের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভরশীল। আশার কথা, ট্রেনটির গন্তব্য স্থির করিবার আংশিক অধিকার ভারতের রহিয়াছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজন তাঁহার পূর্বসূরির ন্যায় দেদার সম্মতি বিলাইয়া আসেন নাই। বরং, তিনি উন্নত বিশ্বের চাপ বহুলাংশে আটকাইতে পারিয়াছেন। কোপেনহাগেন এবং কানকুন, গত দুইটি পরিবেশ সম্মেলনের অভিজ্ঞতায় আশঙ্কা হইতেছিল, রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ বৈঠকও বুঝি বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের দোহা রাউন্ডের আলোচনাচক্রে পরিণত হইল। ডারবান আশার আলো দেখাইয়াছে। ভারত এবং চিন যেমন তাহাদের বৃহত্তর দায়িত্বের কথা স্বীকার করিয়াছে, তেমনই উন্নত দেশগুলিও বুঝিয়াছে, কিয়োটো প্রোটোকলের মৃত্যুকামনাই একমাত্র পরিবেশ নীতি হইলে বিপদ।
কিয়োটোর মৃত্যুকামনা অবশ্য পুরো দমে হইয়াছে। উন্নত দেশগুলি ফের দাবি তুলিয়াছিল, ‘কমন বাট ডিফারেনশিয়েটেড রেসপন্সিবিলিটিজ’ শর্তটিকে বিদায় জানানো হউক। আধুনিক বিশ্ব যতগুলি আন্তর্জাতিক চুক্তি দেখিয়াছে, তাহার মধ্যে কিয়োটো প্রোটোকল উন্নয়নশীল দুনিয়ার প্রতি সর্বাধিক সহানুভূতিপূর্ণ। তাহার প্রাণভ্রমরা এই ‘সি বি ডি আর’ শর্তটি। এই শর্তটি না থাকিবার অর্থ, দূষণের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব উন্নত দেশগুলির রহিয়াছে, তাহাদের আর সেই দায়িত্ব বহন করিতে হইবে না। উন্নয়নশীল দুনিয়ার কম আর্থিক শক্তিসম্পন্ন দেশ, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলিকে বোঝানো হইয়াছে, শর্তটি না থাকিলে তাহাদেরই লাভ চিন ও ভারত তখন আর ‘উন্নয়নশীল’ তকমার আড়ালে নিজেদের দায়িত্ব লুকাইতে পারিবে না। উন্নত দুনিয়ার এই চাল পরিবেশ রাজনীতির চেনা ছক। কোপেনহাগেনে যে দেশগুলি এই ছকের বিরুদ্ধে এক জোট হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে ব্রাজিল কার্যত শিবির পাল্টাইয়াছে। কিন্তু, তাহার পরেও যে কিয়োটো প্রোটোকলের দ্বিতীয় দফা ঘোষিত হইয়াছে, ইহা স্পষ্টতই ভারত এবং চিনের জয়। ভারতের চাপেই ‘পরিবেশ রক্ষার অভিন্ন দায়িত্ব’ মর্মে কোনও আইনি চুক্তি কার্যকর হইতে পারে নাই। পশ্চিমের দেশগুলি যে পরিমাণ ভারত-নিন্দা করিতেছে, তাহাতেই বোঝা সম্ভব, অন্তত এই দফায় ভারত তাহার স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়া আসে নাই। ‘ডারবান প্ল্যাটফর্ম’-এ স্থির হইয়াছে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ২০১৫ সালের মধ্যে নূতন পরিবেশ নীতি স্থির করা হইবে। তাহা কঠোরতর হওয়ারই সম্ভাবনা। বিশ্ব-উষ্ণায়ন যাহাতে এই নীল গ্রহটিকে ধ্বংস না করিয়া ফেলিতে পারে, তাহার জন্য কঠোর নীতিই প্রয়োজন। মাঝখানের চারটি বৎসর অতি জরুরি। বিশেষত ভারতের ন্যায় দেশের পক্ষে। ডারবানে ভারত যে আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন হইয়াছিল, ভবিষ্যতে তাহা আরও বাড়িবে। কাজেই, এই লড়াইয়ে ভারতের এক থাকিলে চলিবে না। চিন এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দোসর। এই দফায় চিন নিজেই ভারতের পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছে। এই সহযোগিতার কূটনৈতিক ভিত্তি শক্ত করা প্রয়োজন। ব্রাজিল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের সহিতও বোঝাপড়ায় আসিতে হইবে। অন্য দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত সহযোগিতাও যেমন প্রয়োজন, তাহার উপর চাপও বজায় রাখা প্রয়োজন। সেই দেশে আগামী বৎসর নির্বাচনে রিপাবলিকানরা জয়ী হইলে কাজটি কঠিনতর হইবে। ভারতকে নিশ্চিত করিতে হইবে, কোনও ভাবেই যেন অভিন্ন দায়িত্বের শর্ত স্বীকৃত না হয়। উন্নত দেশগুলিকে অধিকতর দায়িত্ব লইতে বাধ্য করিতে হইবে। অন্য দিকে, পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির পথেও দ্রুত হাঁটা প্রয়োজন। চিন ঘর গুছাইয়া লইতেছে। ভারত পিছাইয়া পড়িলে লড়াইয়ে একা হইয়া যাইতে পারে। তখন চাপ সামলানো আরও কঠিন হইবে। |