আগুন নির্বাপিত হইয়াছে। মৃতদের শব ব্যবচ্ছেদ শেষ। হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল হইয়াছে। ছয় কর্তা অনিচ্ছাকৃত (গণ)হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হইয়াছেন। জনমানসের ক্ষোভ আর কয়েক দিন পরেই প্রশমিত হইয়া যাইবে, নূতন কোনও বিপর্যয় বা উৎসব আসিয়া ঢাকুরিয়া এ এম আর আই হাসপাতালের বেদনাকে লইয়া যাইবে। তবে কি এই বার সরকারের কর্তব্যের নটে গাছটি মুড়াইবার বেলা আসিল? তেমনই হইয়া থাকে। তাই, নন্দরাম বাজারের আগুন নিভিবার পরে স্টিফেন কোর্টে আগুন লাগে। স্টিফেন কোর্টের ক্ষত শুকাইবার পূর্বেই ঢাকুরিয়ায়। বারণাবত কলিকাতায় অগ্নি বহু চেষ্টাতেও যাহাকে দগ্ধ করিতে পারে নাই, তাহার নাম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অন্তত এই বার প্রশাসন বলুক, আগুন নির্বাপিত হইলেই কর্তব্য ফুরাইয়া যায় না। আগুন কেন লাগে? তাহার প্রথম কারণ, এই শহরে অগ্নি-নিরাপত্তা বিধি বলিয়া কিছুর কার্যত অস্তিত্ব নাই। কিছু আদিম প্রস্তর যুগের নিয়ম রহিয়াছে, যাহার কোনও বাস্তবতা নাই। আন্তর্জাতিক মানের সহিত তাহার আলোকবর্ষের দূরত্ব। শহরের, রাজ্যের সব বহুতলের জন্য নূতন অগ্নি-নিরাপত্তা বিধি প্রণয়ন করিতে হইবে। দায় সারিবার জন্য নহে, সুরক্ষা নিশ্চিত করিবার জন্য। উন্নত দেশগুলি কী করিতেছে, তাহা বুঝিতে হইবে সেই প্রক্রিয়ার সহিত সঙ্গতি রাখিতে হইবে। ভারতে একটি প্রবণতা আছে, এই দেশে যখন নিরাপত্তাবিধি তৈরির আন্তরিক চেষ্টাও হয়, তখনও তাহা ‘ন্যূনতম প্রয়োজনীয়’ স্তরের ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না। কেন ন্যূনতম মানের তিন গুণ ব্যবস্থা করা হইবে না? ইহা তো বিলাসিতা নহে: মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। বিধির ফাঁক গলিয়া যখন নব্বইটির অধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে, তখন বোঝা যায়, বাতানুকূল কক্ষ অপেক্ষা উচ্চমানের অগ্নি-নিরাপত্তা মানুষের আরোগ্যের জন্য অনেক বেশি জরুরি। এতগুলি প্রাণের মূল্যে সরকার তাহা বুঝিবে কি?
অবশ্য, বিধি বাঁধিয়া দেওয়া এক, আর তাহার প্রয়োগ আর এক। হাসপাতালের বেসমেন্টে দাহ্য পদার্থ রাখা যাইবে না প্রায় কাণ্ডজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত এই প্রাথমিক নিয়মটি কলিকাতাতেও আছে। ঢাকুরিয়ার হাসপাতালটি পরিদর্শন করিতে গিয়া দমকলকর্মীরা বে-আইন দেখিয়াছিলেন, তিন মাসের মধ্যে সংশোধন করিতেও বলিয়াছিলেন। সেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার দিন দশেক পরেই আগুন লাগিল। ইত্যবসরে প্রশাসন দেখিতে সময় পায় নাই যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আদালতে হলফনামা দিয়া যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, তাহা রাখিল কি না। আন্তর্জাতিক মানের বিধি তৈরি হইলেও যত ক্ষণ প্রশাসন তাহা প্রয়োগ করিতে আন্তরিক ভাবে চেষ্টা না করিবে, তত ক্ষণ সব বিধিই অসার। পরিদর্শক দলের হাতে কিছু টাকা গুঁজিয়া দিলেই আর নিয়ম মানিবার দায় থাকে না এই অভিজ্ঞতা সর্ব স্তরের। এই বিষচক্র ভাঙিতেই হইবে। নূতন বিধি তৈরি করিবার পর শহরের সব বহুতলে, সব প্রতিষ্ঠানে তাহা যাহাতে যথার্থ ভাবে প্রযুক্ত হয়, তাহা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। যাহারা নিয়ম মানিবে না, তাহাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করিতে হইবে। প্রয়োজনে ব্যবসার অধিকার কাড়িয়া লইতে হইবে। প্রশ্নটি যখন জীবন-মৃত্যুর, তখন ন্যূনতম বিচ্যুতিও সহ্য করা চলিবে না। মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবারের দুর্ঘটনার পর তৎপর হইয়াছেন, নিজে উপস্থিত থাকিয়া উদ্ধার প্রক্রিয়ার তদারকি করিয়াছেন। তৎপরতাটি এইখানেই শেষ হইলে চলিবে না। তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। পুরসভা হইতে দমকল, পুলিশ হইতে পূর্ত দফতর সবাই যাহাতে সাযুজ্য বজায় রাখিয়া শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে সক্রিয় হয়, তাহা দেখা মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। প্রশাসন তাহার দায়িত্ব পালন করিতেছে কি না, সেই দিকে নজর রাখিতে হইবে। প্রশাসনিক গাফিলতি দেখিলে সরব হইতে হইবে। আর কোনও প্রাণ যাহাতে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার আগুনে দগ্ধ না হয়, তাহা নিশ্চিত করিতেই হইবে। |