শীর্ষ নেতা গণপতির জেলা থেকেই উৎখাত মাওবাদীরা
ত্তর অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলা মাওবাদীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেই জেলার সদর করিমনগর শহর থেকে দু’দিন ধরে কিষেণজির বাড়ি পেড্ডাপল্লিতে যাতায়াতের পথে হায়দরাবাদ থেকে ফোন করলেন বন্ধু পুলিশ অফিসার। বললেন, “এত দূরে এলেন। গণপতির গ্রামটা ঘুরে যাবেন না!”
গ্রামের নাম বীরপুর। করিমনগর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামেই মাওবাদী সংগঠনের শীর্ষতম নেতা লক্ষ্মণ রাও ওরফে গণপতির জন্ম-ভিটে। গ্রামে ঢোকার মুখে পিচ রাস্তার পাশে মোবাইলের দোকান। পাকা বাড়ির ছাদে ‘ডিশ-অ্যান্টেনা’। মাওবাদী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাত বীরপুর গ্রামে এটাই আজকের ছবি। দু’টি ভাঙাচোরা দেওয়াল আর কিছু আগাছার জঙ্গল গণপতির বাড়ির সাক্ষ্য হিসেবে এ’টুকুই শুধু রয়ে গিয়েছে।
গ্রামে সুধাকর রাও-এর এক তলা পাকাপোক্ত বাড়ি। বারান্দায় সোফায় আরামে গা এলিয়ে দিয়ে জানালেন, গণপতির ছেলে-বৌমা এখন আমেরিকায় থাকেন। স্ত্রী হায়দরাবাদে। তাঁর ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও থাকেন আমেরিকায়। সুধাকর সম্পর্কে গণপতির ভাগ্নে। দু’বছর আগে এক আত্মীয়ের বিয়েতে হায়দরাবাদে গিয়ে দেখা হয়েছিল গণপতির ছেলে বাসু শ্রীনিবাস রাওয়ের সঙ্গে। তখনই জানতে পারেন, বাসু এখন বিদেশবাসী।
১৯৬৯ সালে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে অন্ধ্র জুড়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন কিষেণজি এবং গণপতি। তাঁদের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েন মেধাবি যুবকের দল। ঠিক যেমনটা পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলনের সময়ে ঘটেছিল। অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশের মারমুখী অভিযানে গ্রাম-শহর ছেড়ে জঙ্গলে সরে আসেন গণপতি-কিষেণজিরা। সেখানেই জন্ম আজকের মাওবাদী দলের। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রচুর যুবক-যুবতী দলে দলে যোগ দেন তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু সে সবই আজ অতীত।
আজ, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরের দশটি জেলার বেশির ভাগ মানুষ আলাদা তেলেঙ্গানা রাজ্য চাইলেও, সেই আন্দোলনে মাওবাদীদের সংস্পর্শ চান না। বীরপুরের পথে গঞ্জ শহর ধরমপুরি। সেখানে দেখা স্থানীয় সাংবাদিক রামকৃষ্ণনের সঙ্গে। জানালেন, ২০০৪ সালে পুলিশের গুলিতে মারা যান স্থানীয় মাওবাদী নেত্রী রজিতা ওরফে পদ্মকা। তার পর থেকে কার্যত যতি চিহ্ন পড়ে গিয়েছে তেলেঙ্গানা এলাকায় মাওবাদী আন্দোলনের।
গত কয়েক বছরে করিমনগর ও আশপাশের জেলা থেকে বহু যুবক-যুবতী চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সুধাকর বলছিলেন, বীরপুর গ্রামেরই বহু যুবক এখন সৌদি আরব, আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রবাসী। তাই, ‘সমাজ বদলে ফেলার’ সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য এখন আর স্থানীয় যুবকদের দলে পাচ্ছেন না মাওবাদী নেতারা। তাই উপকূলবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর, নেলোর, বিশাখাপত্তনম থেকে যুবক নিয়োগ শুরু হয়েছে। অথচ, বিভিন্ন সময়ে এই করিমনগর জেলা থেকেই ১৫ জন মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা উঠে এসেছেন। কিষেণজি-গণপতিরা গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে চলে যাওয়ার পরে নারায়ণ রাও, অঞ্জইয়া, ওদেলু, বিছাইয়া-সহ গ্রামের জনা ছয়েক যুবক নেমে পড়েছিলেন আন্দোলনে। নারায়ণ রাও ছাড়া সেই দলের এখন আর কেউ বেঁচে নেই। কার্যত, মাওবাদী দলের পলিটব্যুরোর সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে এখন জনা পাঁচে ঠেকেছে। তাঁদের মধ্যে গণপতি ছাড়া আর বিশেষ কেউ সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে নন। বাঙালি নেতা প্রশান্ত বসু ওরফে কিষাণদা অহিংস মতের সব চেয়ে বড় সমর্থক। দলে এখন তাঁর কর্তৃত্ব বাড়ছে। দণ্ডকারণ্যে বসে তা নিয়ে দলের মধ্যে চলছে বিস্তর তর্ক।
সম্প্রতি ইন্ডিয়ান পুলিশ জার্নালে লেখা এক প্রবন্ধে হায়দরাবাদ পুলিশের আইজি অঞ্জনি কুমার প্রশ্ন তুলেছেন, “এ ভাবে কত দিন গেরিলা-যুদ্ধ চালানো সম্ভব? ওরা উন্নয়ন চাইছে। উন্নয়ন হতেই গ্রামের গরিব যুবকদের সামনে খুলে যাচ্ছে বহির্বিশ্বের দরজা। তাঁরা গ্রাম ছেড়ে শহরে, শহর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ভারতের মতো বৃহৎ দেশের রাষ্ট্র-শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যে লোকবল, অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন, তা কি এখন মাওবাদীদের কাছে রয়েছে?” অন্ধ্রপ্রদেশের যে বিশেষ বাহিনী মাওবাদীদের কার্যত রাজ্যছাড়া করে দিয়েছে, সেই ‘গ্রে-হাউন্ড’-এর প্রাক্তন আইজি অঞ্জনি কুমারের বক্তব্য, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য মাওবাদীরা যত আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করবে তত সুবিধা হবে পুলিশের। বার বার এই ফাঁদেই পা দিচ্ছে মাওবাদীরা। কিষেণজিও এ ভাবেই ফাঁদে পা দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, দণ্ডকারণ্যে দলের শীর্ষ কিছু নেতা এবং বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গে তৈরি করা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ছোট ছোট দল ছাড়া মাওবাদীদের অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে।
প্রশ্ন উঠছে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিষেণজি-পরবর্তী অধ্যায়ে তাঁর ভাই বেনুগোপাল রাও-কে এই রাজ্যের দায়িত্ব দিলেও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় লোক-লস্কর, রসদ গণপতিরা কোথা থেকে পাবেন? বাংলার গ্রামের ক্লাশ ফাইভ পাশ করা যুবকদের নিয়ে কত দূর এই আন্দোলন বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? অন্ধ্র থেকে ‘সাপ্লাই চেন’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে প্রথম সারির নেতা কোথা থেকে উঠে আসবে? পুলিশের গুলিতে সিদু সোরেনের মতো তরতাজা যুবকের মৃত্যুর পরে ক’জন নতুন করে সশস্ত্র আন্দোলনে আসবেন?
পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের পিছিয়ে পড়া গ্রামের যে গরিব-গুর্বো যুবকদের দলে আনা গিয়েছিল, তা প্রধানত অস্ত্র ও টাকার লোভ দেখিয়ে। সে অর্থে ‘আদর্শ’ থেকে সশস্ত্র বিপ্লবে আসার মত আবেগ, চেতনা, পড়াশোনার অভাব রয়েছে তাঁদের। যে ‘বিশিষ্ট জনেরা’ শহরে বসে আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, কিষেণজি-র মতো তাঁদের কেউ অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নামবেন অদূর ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনা খুবই কম। হায়দরাবাদের এক পুলিশ অফিসারের প্রশ্ন, “আপনাদের রাজ্য থেকে যদি প্রথম সারির নেতা না উঠে আসে, তা হলে কত দিন ধরে অন্ধ্রের লোক গিয়ে সেখানকার আন্দোলন পরিচালনা করবেন? বেনুগোপাল গেলেও তাঁর এলাকা চিনতে সময় লাগবে। কিষেণজির যে আকর্ষণ ক্ষমতা ছিল, তা বেনুগোপালের রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে। তা ছাড়া এখন তো আপনাদের রাজ্যেও উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। ফলে গ্রামের মানুষ বঞ্চিত, সেই তত্ত্বও বোধ হয় খাটছে না।”
অন্ধ্রপ্রদেশের উদাহরণ টেনে সাংবাদিক রামকৃষ্ণনের বক্তব্য, তেলেঙ্গানার দাবিকে জোরদার করার স্বার্থে এই রাজ্যে এক সময়ে মাওবাদী আন্দোলনকে কাজে লাগিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। কখনও কংগ্রেস, কখনও তেলুগু দেশম পার্টি। কিন্তু, ১৯৯৬ সালের পরে রাজ্যের এই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের স্বার্থে মাওবাদীদের ব্যবহার করা বন্ধ করে দেন। আর তার পর থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ, বিশেষ করে ‘গ্রে-হাউন্ড’-এর পক্ষে অভিযান চালানো সহজ হয়ে যায়। কার্যত এই রাজ্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মাওবাদীরা। সম্প্রতি ২০০৯ সালে পৃথক তেলেঙ্গানার দাবিতে নতুন করে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় করিমনগর ঘিরে। কিষেণজির এক সময়ের সঙ্গী গদরের দাবি, জঙ্গলে বসে সেই আন্দোলনও নাকি পরিচালনা করছিলেন কিষেণজিরা। কিন্তু, এই তথ্য মানতে নারাজ রামকৃষ্ণন। তাঁর দাবি, তেলেঙ্গানা সংক্রান্ত কোনও আন্দোলনেই আর দাঁত ফোটাতে পারবে না মাওবাদীরা। মানুষই তাদের চান না।
এখানেই আবার উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ। অভিযোগ, গড়বেতার ছোট আঙারিয়া থেকে শুরু করে লালগড়, নন্দীগ্রাম আন্দোলনে কোনও না কোনও ভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে মাওবাদীদের ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এই রাজ্যে টিকে থাকার (তা সে জঙ্গলেই হোক না কেন) রসদের নিয়মিত জোগান ছিল তাঁদের কাছে। সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর একের পর এক সফল অভিযানে এই রাজ্যে কার্যত কোমর ভেঙে গিয়েছে মাওবাদীদের। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকেও সমর্থন পাচ্ছেন না তাঁরা। অঞ্জনি কুমারের কথায়, “এই অবস্থা চলতে থাকলে আপনাদের রাজ্য থেকে মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন হতে বড়জোর আর দু’তিন বছর সময় লাগবে।”
কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের লালগড় ও সংলগ্ন এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মাওবাদীরাও যে রাজনৈতিক সমর্থন জুটিয়ে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করবে, তা স্বাভাবিক। দণ্ডকারণ্য থেকে নেপাল পর্যন্ত যে করিডরের স্বপ্ন দেখেন মাওবাদী নেতৃত্ব, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল ভৌগোলিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, রাজনীতির স্বার্থে ভবিষ্যতে এ রাজ্যে যে আর মাওবাদীদের ‘কাজে লাগানো’ হবে না, এ কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সুতরাং বিপদ এখনই কাটছে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.