আট জনকে বাঁচিয়ে শহর ছাড়লেন কফিনবন্দি বিনীতা
বাবা দিনমজুর। মা কিডনি রোগী, প্রতি মাসেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এক বোন এখনও স্কুলে পড়ছে। টাকার খুব দরকার। পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে কেরলের কোট্টায়াম থেকে মাস চারেক আগে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। রবিবার কফিনবন্দি হয়ে কলকাতা ছাড়লেন অন্য আট জনের প্রাণ বাঁচিয়ে।
তিনি, বিনীতা পিটি, মাত্র এক রাতেই হয়ে উঠেছেন সকলের থেকে ‘আলাদা’। ২১ বছরের মেয়ের কফিনবন্দি দেহ রবিবার সকালে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার সময় তাঁর সতীর্থদের চোখের জল আর তাই বাঁধ মানেনি।
মাত্র চার মাস ঢাকুরিয়ার এএমআরআই হাসপাতালে কাজ করছিলেন তিনি। চার মাসে এমন কিছু করে দেখানোর সুযোগ পাননি, যার জন্য তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করা যেতে পারে। ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের শ’চারেক নার্সের মধ্যে তিনি ছিলেন নিতান্তই সাধারণ এক জন। কিন্তু বৃহস্পতিবারের নজিরবিহীন দুর্ঘটনার পরে তিনিই হয়ে উঠলেন এমন এক জন, যাঁর উদাহরণ এখন সহকর্মী থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসক, অন্য কর্মী, এমনকী রোগী বা তাঁদের আত্মীয়দের মুখে মুখে। নিজের জীবনের বিনিময়ে আট জন রোগিণীকে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে বাঁচাতে পারেননি বিনীতা। প্রবল ধোঁয়ায় দম আটকে তাঁরই সঙ্গে মারা গিয়েছেন ওই ওয়ার্ডেরই আর এক নার্স রামিয়া রাজনও। তিনিও কেরলের বাসিন্দা। তাঁর পরিবারের লোকেরাও এ দিন মৃতদেহ উড়ানে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
বিনীতার ছবি হাতে তাঁর
এক সহকর্মী। নিজস্ব চিত্র
কলকাতা বিমানবন্দরে কফিনবন্দি রামিয়ার
পাশে বন্ধুর শেষ শ্রদ্ধা। ছবি: সুমন বল্লভ
দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পরে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করেছিলেন বিনীতা। নিজের এলাকায় নার্সের চাকরি করে যে টাকা পাচ্ছিলেন, তা তাঁদের গরিবের সংসারে সকলের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই প্রথমে হায়দরাবাদ, পরে কলকাতার হাসপাতালে চাকরি। মালয়ালম ভাষা ছাড়া আর কিছু তেমন ভাবে বুঝতেন না। বাংলা বা হিন্দি তো নয়ই, বড় জোর ভাঙা ভাঙা ইংরাজি। কিন্তু উচ্চারণগত সমস্যার জন্য তাও অনেকে বুঝতে পারতেন না। এই ভাষার সমস্যার জন্য রোগীদের কাছে বার বার তিরস্কৃত হতেন বিনীতা বা তাঁর মতো অন্যরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে একাধিক বার লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে। কর্তৃপক্ষও ডেকে বকাঝকা করেছেন। কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যে ভাবে রোগীদের হাজারো অসুবিধা সত্ত্বেও মালয়ালি-মণিপুরি নার্সদের নিয়োগ করা হয়, তাঁরাও থেকে গিয়েছেন সেই ভাবেই।
বিনীতার এক সহকর্মী জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেও এক রোগিণীর বক্তব্য বুঝতে না পারায় বকুনি খেয়েছিলেন বিনীতা। একটু মনমরাও ছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেও মাঝ রাতে যখন ওই দুর্ঘটনার কথা বুঝতে পারেন, তখন নিজের কথা না ভেবে ওয়ার্ডের রোগিণীদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কথাই তাঁর সবচেয়ে আগে মনে হয়েছিল।
শনিবার দুপুরে যখন বিনীতার কাকা হাসপাতালে পৌঁছন, তখন তাঁর সঙ্গে একটি বার দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন তাঁর সহকর্মীরা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁদের সেই অনুমতি দেননি। ফলে যত বার তাঁরা সকলের নজর এড়িয়ে এক তলার রিসেপশনে পৌঁছেছেন, তত বারই কর্তৃপক্ষের তরফে কেউ না কেউ তাঁদের ডেকে নিয়েছেন। রবিবার বিনীতা ও রামিয়ার শেষ যাত্রায় যাওয়া নিয়েও কর্তৃপক্ষের তরফে বাধা ছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু সেই কথায় তাঁরা কেউ কান দেননি।
বিনীতা কি বরাবরই এমন সাহসী? সতীর্থরা জানিয়েছেন, একেবারেই না।
একটু চুপচাপ, ভীতু প্রকৃতিরই ছিলেন তিনি। ওই ওয়ার্ডেরই এক নার্সের কথায়, “অল্পে বিচলিত হয়ে পড়ত ও। তবে কাজে কখনও ফাঁকি দেয়নি। ডিউটির সময়ে ওকে কখনও গল্প করার জন্য ডাকলে ‘না’ বলে দিত। সে দিন রাতে এই ডিউটির তাগিদেই ও প্রাণটা দিয়ে দিল।”
বিনীতার কাকা বিজয়নও দিনমজুর। ভাইঝির দেহ নিতে এসে দু’দিনের রুজি কামাই হয়েছে তাঁর। বললেন, “ও যা করেছে তা টিভির দৌলতে আমাদের ওখানেও সবাই জানে। ওঁর জন্য মাথা উঁচু হয়ে গেল আমাদের সবার। সবাই আমাদের দেখিয়ে বলবে, ওই যে বিনীতার বাড়ির লোকেরা যাচ্ছে!”
হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে মালয়ালম ভাষায় বলে বিজয়নের কথাগুলো যিনি হিন্দিতে তর্জমা করে দিচ্ছিলেন, সেই জয়সান আব্রাহাম নিজেও কেরলের বাসিন্দা। ইএম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের তিনি ‘মেল নার্স’। জয়সান বললেন, “আমরা ভিন রাজ্যের হতে পারি। কিন্তু রোগীদের জন্য আমাদের সেবায় কোনও ঘাটতি নেই, এই মেয়েটা জীবন দিয়ে সেটাই প্রমাণ করে দিয়ে গেল।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.