আর্থিক সঙ্কটের জন্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের একাংশের পেনশন বন্ধ। পরিবহণ ক্ষেত্রে সিএসটিসি-র পরিচালন পর্ষদের সদস্য, চেয়ারম্যান ও অন্য উচ্চ পদস্থ কর্তাদের বেতন, ভাতা ও সাম্মানিক বন্ধ করে সেই টাকায় অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের প্রাপ্য মেটানোর নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের মন্ত্রী ও বিধায়কদের ভাতা বাড়ানোর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সিদ্ধান্ত তাঁরই সরকারের কর্মীদের কাছে ‘ভুল বার্তা’ পাঠাবে বলে মনে করছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ।
রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে মঙ্গলবারই মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়েছে। অর্থ দফতরের একটি সূত্রের হিসাবে, ওই ভাতা বৃদ্ধির ফলে বছরে প্রায় দু’কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত খরচ হবে। যা সরকারের সামগ্রিক ব্যয়ের নিরিখে খুব বড় অঙ্ক নয়। সেখানে কর্মীদের মাত্র ১% মহার্ঘ ভাতা দিতে সরকারের খরচ হবে বছরে ৩০০ কোটি (মাসে ২৫ কোটি) টাকা। কিন্তু সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য আটকে থাকার সময়ে মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ‘নৈতিকতা’র প্রশ্ন তুলছে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন। রাজ্যের প্রধান বিরোধী
দল সিপিএমেরও প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রীই যেখানে বলছেন ‘৬ পয়সার সরকারে’র আর্থিক সঙ্কট কর্মচারীদের পাওনা মেটানো-সহ নানা কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? সে ক্ষেত্রে তো মুখ্যমন্ত্রীর আর্থিক যুক্তি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি কাজে থাকলে এক জন মন্ত্রী প্রতি দিন ১০০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। তাঁর মাসের বেতন ৭৫০০ টাকা (প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৭২০০ টাকা) থাকছে। একই ভাবে অধিবেশন চলাকালীন বিধায়কদের ভাতা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে এক জন মন্ত্রী মাসে সর্বোচ্চ ৩১ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা পেতে পারেন। অর্থ দফতরের এক মুখপাত্র জানান, এ রাজ্যে মন্ত্রীর সংখ্যা ৫০-এর নীচে। আর বিধায়কের সংখ্যা ২৯৪ জন। দু’টি মিলিয়েই খরচ বৃদ্ধির অঙ্কটা বছরে প্রায় দু’কোটি টাকা।
সরকারি কর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, গত এক বছরে এক শতাংশও না মেলায় বকেয়া মহার্ঘ ভাতার পরিমাণ এখন বেড়ে হয়েছে ২৩%। আগামী জানুয়ারিতে এটা বেড়ে ৩২% হওয়ার কথা। কর্মচারীদের ‘প্রাপ্য’ না-মিটিয়ে মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্তের মধ্যেই ‘নৈতিকতা’র অভাব দেখছেন কর্মচারী নেতারা।
বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তবে সরকারি কর্মীদের প্রতি ‘ভুল বার্তা’ সংক্রান্ত প্রশ্নের সরাসরি জবাব না-দিয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “বিগত সরকারের আমলেই প্রস্তাব এসেছিল। ভাতা বেড়েও আমাদের রাজ্যের বিধায়কেরা যা পাবেন, তা অন্য রাজ্যের চেয়ে কম।” পার্থবাবুর দাবি, বিধানসভার এনটাইটেলমেন্ট কমিটিতে দল-মত-নির্বিশেষে সকলেই ভাতা বাড়ানোর দাবি সমর্থন করেছিলেন। পার্থবাবুর যুক্তি, “বহু বিধায়ক আছেন, যাঁদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বিধায়ক হিসাবে এঁদের কিছু কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে, মানুষের অনেক চাহিদা থাকে তাঁদের কাছে। সে সব সামলানোর জন্যই ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। তবুও যা হয়েছে, তা দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় কম।”
সরকারি কর্মচারীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন, সিপিএম-প্রভাবিত রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, “মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাতা বাড়ায় আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী স্ববিরোধী কথা বলছেন। যখন তাঁকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন তিনি আর্থিক সঙ্কটের কথা বলছেন। অথচ মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাতা বাড়িয়ে দেওয়া হল। এর ফলে সরকারের নৈতিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।” কর্মচারীদের অন্য সংগঠন ‘আসা’-র সম্পাদক সৌমিত্র গুহ, কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর যুগ্ম সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায়ও এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ভাল ভাবে নিতে পারছেন না তৃণমূল পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ১ আনায় (৬ পয়সা) কেউ সরকার চালাতে পারলে কান কেটে দিয়ে দেব! ৬ পয়সার ওই হিসাবটা ঠিক নয়। তা-ও যদি সেটাই সত্যি হয়, তা হলে কর্মচারীদের পাওনা আটকে থাকার সময় এই সিদ্ধান্ত কী ভাবে হল? ওঁকে বলছি, এই ভাবে সত্যিই সরকার চলে না। কান যদি থাকে, তা হলে কেটেই ফেলুন!” |