আয়লা-উত্তর পর্ব

জৈব-কৃষি নির্ভর উন্নয়নের সন্ধান সুন্দরবনে
য়লার বিধ্বংসী পরিণতি পিছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়াতে জৈব-কৃষি নির্ভর উন্নয়নের পথে হাঁটছেন সুন্দরবনের মানুষ।
পাথরপ্রতিমা, হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা বা ছোট মোল্লাখালির গ্রামগুলোতে চাষিরা এখন রাসায়নিক সার নির্ভর উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ ছেড়ে দেশি ধানের চাষ করছেন বেশি করে। কেবল লবন-সহনশীল জাতের ধান চাষই নয়, চাষিরা দুর্মূল্য রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ছেড়ে গোবর এবং অন্যান্য স্থানীয় ভাবে লভ্য সামগ্রী দিয়ে নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন জৈব সার এবং কীটনাশক। তাতে চাষের খরচ কমছে, বাড়ছে মাটির উর্বরতা।
পাথরপ্রতিমার ইন্দ্রপ্রস্থ, যোগিন্দ্রপুর, গোবিন্দপুর, বিশ্বনাথপুর, শিবপুর, সাগরমাধবপুর, গয়াধাম বা রামগঙ্গাপুরের মতো গ্রামগুলোতে অন্তত ২০০ জন চাষি সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ত্যাগ করেছেন। একই সঙ্গে ওই সব গ্রামে পুকুরে দেশি মাছের চাষ, পুকুরপাড়ে সব্জি চাষ, দেশি হাঁস-মুরগি পালন এবং গোবর গ্যাসের ব্যবহার সব মিলিয়ে এক সুসংহত কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের সার্বিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
সুন্দরবনে এ ভাবেই ধানের সঙ্গে হচ্ছে সব্জি চাষ। নিজস্ব চিত্র।
বিশ্বনাথপুরের সুকোমল মণ্ডল বছর দু’য়েক হল রাসায়নিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করেছেন। তাঁর দেখাদেখি ওই অঞ্চলে আরও অন্তত ২০ জন চাষি পুরোপুরি জৈব-কৃষিতে ফিরেছেন। তাঁরা কেবল চাষেই জৈব পদ্ধতি গ্রহণ করেননি, জীবনযাপনেও পরিবেশ-বান্ধব জৈব পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন। ওই অঞ্চলে অন্তত ৬০টি পরিবারে রান্নাঘরে কাঠ বা ঘুঁটের জ্বালানি ঢোকে না। বাড়িতে তাঁরা গোবর গ্যাসের প্ল্যান্ট বসিয়েছেন। ফলে, গোবরজাত ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস যেমন আর প্রকৃতিতে মুক্ত হচ্ছে না, তেমনই গোবর থেকে তৈরি হচ্ছে বিনা পয়সার সার। তা ছাড়া, কাঠ বা ঘুঁটে পোড়ালে যে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, তার থেকেও নিষ্কৃতি মিলছে।
এ সবই শুরু হয়েছে আয়লার পরে সুন্দরবনের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বিকল্পের সন্ধান থেকে। ওই দুর্যোগের পর থেকেই চাষিরা প্রায় তিন দশক পরে দেশি ধানের খোঁজ করতে শুরু করেন।
কেন দেশি ধান?
কারণ, মাটি ও পরিবেশের লবনাক্ততা সহ্য করেও ভাল ফলন দিতে পারে দেশি ধান। দেশি ধান ‘জনপ্রিয়’ হওয়ার আর একটা কারণ, তার প্রাণশক্তি। অল্প বৃষ্টিতেই সুন্দরবন এলাকায় জমিতে জল জমে উচ্চফলনশীল ধানের গাছ পচে যায়। কিন্তু বর্ষার জমা জলেও দেশি ধান ভাল ফলন দেয়। আয়লা-পরবর্তী সুন্দরবনে তা পরীক্ষিতও হয়েছে। চাষিরা এখন বুঝতে শিখেছেন, সুন্দরবনের নোনা মাটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার আদতে কতটা ক্ষতিকর। তাঁরা জানাচ্ছেন, ক্রমাগত রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটি শক্ত হয়ে যায়। তখন বেশি সার দিলেও ফলন কমতে থাকে। তা ছাড়া, রাসায়নিক সারের খরচ এত বেশি, যে পোষানো দুষ্কর। সুকোমল মণ্ডলের দাবি, “এক বিঘে জমিতে ধান করতে ইউরিয়া, সুপার ফসফেট আর পটাশের মতো রাসায়নিক সার দিতেই তিন হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। তাতেও বিঘেতে ১২ মণের বেশি ধান ওঠে না। তার চেয়ে জৈব সার অনেক ভাল। নিজেকে খেটে তৈরি করে নিতে হয়, খরচ প্রায় নেই বললেই চলে।” সুন্দরবনের ওই চাষির অভিজ্ঞতা, “জৈব সার প্রয়োগে মাটি নরম হচ্ছে। সারের প্রয়োজন কমছে, ফলনও বাড়ছে।”
ইন্দ্রপ্রস্থ গ্রামের একটি কৃষি সংগঠন এখন ২০টি দেশি জাতের ধান সংরক্ষণ বাড়িয়ে তোলার কাজ করছে। একই কাজ বড় আকারে করছে হিঙ্গলগঞ্জ থানার যোগেশগঞ্জের আর একটি কৃষি সংগঠন। ওই সংগঠনের সম্পাদক জানান, ১২টি লবন সহনশীল দেশি ধান-সহ মোট ১১২ জাতের দেশি ধান তাঁরা সংরক্ষণ করছেন। সেই ধান চাষিদের মধ্যে এতটাই ‘জনপ্রিয়’ হয়েছে যে, এখন ওই এলাকার অন্তত ৩০% চাষি দেশি ধানের চাষ করছেন। ছোট মোল্লাখালির অন্তত দশটি গ্রামে ‘নোনাবখরা’, ‘লালগেটু’, ‘নোনাশাল’, ‘তালমুগুর’-এর মতো লবন-সহনশীল দেশি জাতের ধান চাষ হচ্ছে গত বছর থেকে। আয়লায় বাঁধভাঙা নোনা জলের তাণ্ডবের পরে এখনও মাটির লবনাক্ততা কাটেনি। তাই চাষিদের ভরসা সেই দেশি ধানেই। তাঁরা ধানের বীজ পেয়েছেন চুচুঁড়ার ধান গবেষণা কেন্দ্র থেকে।
মাটিতে লবনের পরিমাণ জানতে পারলে বীজ নির্বাচন এবং সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ণয়ে সুবিধা হয় চাষির। তা মাথায় রেখে আয়লার পরে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সুন্দরবনের চাষিদের কলকাতায় পরিবেশ ভবনে এনে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেই কর্মশালায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ রথীন্দ্রনাথ রায় চাষিদের হাতে তুলে দেন মাটিতে লবনের মাত্রা নির্ণয়ের সহজ এবং প্রায় নিখরচার কারিগরি। পর্ষদের দশ জন বিজ্ঞানীকে ওই কারিগরির বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে চাষিদের তা শেখানোর জন্য। পরে রাঙাবেলিয়ায় সেখানকার চাষিদের ওই কারিগরি শেখানোর জন্য দু’টি কর্মশালার ব্যবস্থাও করে পর্ষদ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.