করলা নদীতে মাছের মড়কের পিছনে রয়েছে নিষিদ্ধ কীটনাশক এন্ডোসালফান। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তেমন প্রমাণই মিলেছে। ওই বিভাগের প্রধান সুদীপ বরাট বুধবার বলেছেন, “জলের নমুনা আর মাছের দেহের ব্যবচ্ছেদ করে জানা গিয়েছে যে, করলায় এন্ডোসালফান জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছিল। অতিমাত্রায় ওই কীটনাশক প্রয়োগের ফলেই এত মাছের মৃত্যু হয়েছে।” এন্ডোসালফান ব্যবহারের ফলে নদীর ভারসাম্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে তিনি
মনে করেন।
এন্ডোসালফান নিষিদ্ধ কীটনাশক। এ বছরের ১৩ মে আদালত এন্ডোসালফানের উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০০৬ সালে কেরলে এন্ডোসালফান ব্যবহার নিয়ে প্রচুর হইচই হয়। এই কীটনাশকের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ব্যবহারের ফলে বহু লোকের মৃত্যু হয়। অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। সরকার মৃতের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ দেয়। ২০১২ সাল থেকে এই কীটনাশক সারা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
করলা নদীতে কে বা কারা এন্ডোসালফান প্রয়োগ করল তা জানা যায়নি। তবে, এন্ডোসালফান যে এখনও ব্যবহার হচ্ছে তাতে অনেকেই বিস্মিত। জলপাইগুড়ি সায়েন্স অ্যান্ড নেচার ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক রাজা রাউত বলেন, “আমরা অবাকই হয়েছি। চা বাগানে এক সময় এই কীটনাশক ব্যবহার করা হত। এখনও নিশ্চয় চোরাপথে এর ব্যবহার আছে। কারণ, এটি কার্যকরী এবং খরচও কম।” |
করলা নদীর জল পরীক্ষা করছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ দল। বুধবার সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
এন্ডোসালফান নদীতে কী করে এল তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। কারণ, এখন বর্ষাকাল নয়। চা বাগানের মাটি ধোওয়া জলও নদীতে পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অনেকের অনুমান, চা বাগানে ব্যবহৃত কীটনাশকের পাত্র কেউ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আগে সেটি নদীতে ধুয়েছিলেন।
শুধু মাছ নয়, করলা নদীতে বিষক্রিয়ায় জলজ উদ্ভিদ-সহ অসংখ্য জলচর পোকাও মরেছে। বিষক্রিয়ার প্রভাব দ্রুত না-কাটলে নদীর জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। বুধবার উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান সুদীপ বরাটের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল জলপাইগুড়িতে এসে দিনভর করলা নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে জলের নমুনা ও মৃত মাছের দেহ নিয়ে পরীক্ষা চালায়। বিশেষজ্ঞেরা মৃত মাছের ব্যবচ্ছেদ করে মাছের পেটে কালো জমাট অংশ এবং একটি তরল পিচ্ছিল রাসায়নিক পেয়েছেন। বোয়াল মাছের ফুসফুসেও বিষক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তবে, বুধবারেও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সরকারি রিপোর্ট প্রশাসনের কাছে জমা পড়েনি। পর্ষদ সূত্রে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনকে ‘মৌখিক ভাবে’ জানানো হয়েছে, জলে অতি বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে যাওয়াই মাছের মড়কের কারণ। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আজ, বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়িতে আসছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কুমার দত্ত। একই দিনে করলা নদীতে বিষক্রিয়া নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করতে আসছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। রাজ্যের মৎস্য দফতরের উপ-অধিকর্তা আফরিন সাবা আলভির নেতৃত্বে আরও একটি প্রতিনিধিদল এ দিন জলপাইগুড়িতে আসবেন বলে জানা গিয়েছে। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্র বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।”
বুধবার বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতর ও করলা নদীর মৎসজীবীদের নিয়ে বৈঠক করেছে জেলা মৎস্য দফতর। দফতরের সহকারী অধিকর্তা সোনম সেওয়া বলেন, “নদীতে নজরদারি চালানোর জন্য বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠনের প্রস্তাবও জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে।” এ দিনও নদী থেকে মৃত মাছ তুলে ফেলার কাজ চালিয়েছে জলপাইগুড়ি পুরসভা। চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “নদীর জলকে বিষমুক্ত করার কাজ চলছে।” |