কেষ্টপুরের তৃণমূল নেতা স্বপন মণ্ডল খুনের ঘটনায় পুলিশি তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই সামনে আসছে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। স্বপনকে খুনের অভিযোগে বুধবার ডানকুনি থেকে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিশ্বজিৎ দাস ওরফে টুলকো এবং রাধাকান্ত ঘোষ নামের ওই দুই যুবকই তৃণমূল আশ্রিত বলে পুলিশের দাবি। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “জেরায় ধৃতেরা অপরাধ কবুল করেছে। তাদের কাছ থেকে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র, চার রাউন্ড গুলি পাওয়া গিয়েছে। উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র থেকেই গুলি চালানো হয়। আগ্নেয়াস্ত্রটি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।”
জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, টুলকো কেষ্টপুর-রাজারহাট এলাকায় তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত। সে রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার এক তৃণমূল কাউন্সিলরের ছেলের ঘনিষ্ঠ। পুলিশের বক্তব্য, সিন্ডিকেট ব্যবসার বখরা নিয়ে রাজারহাট এলাকায় স্বপন এবং টুলকোদের দল ছিল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এবং সম্প্রতি সিন্ডিকেট ব্যবসা নিয়ে ওই কাউন্সিলর-পুত্রের সঙ্গে স্বপনদের গোলমাল এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে তারা একে অন্যকে খুনের চেষ্টাও করতে থাকে। টুলকোদের গোষ্ঠী মাস তিনেক আগেও স্বপনকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের বক্তব্য। হাতে গুলি লাগলেও সে সময়ে কোনও মতে পালিয়ে বাঁচেন স্বপন। |
তদন্তকারীরা দাবি করেন, এ বারে যাতে আর ভুল না হয়, সে জন্য ‘পাকাপোক্ত’ ছক করা হয়। স্বপন-হত্যার দিন কয়েক আগে ওই কাউন্সিলরের স্ত্রীর পারলৌকিক কাজ ছিল। ভিআইপি রোডের ধারে উমাশঙ্কর কলেজের কাছে একটি বাড়িতে ছিল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। সেখানে হাজির ছিল দমদম এবং কেষ্টপুর এলাকার বহু দুষ্কৃতী। পুলিশের দাবি, তাদের আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন তৃণমূলের এক নেত্রীও। সেখানেই স্বপন-খুনের ছক তৈরি করে দুষ্কৃতীরা। পুলিশের দাবি, ওই খুনের ঘটনায় রাজারহাট-গোপালপুর টাউন তৃণমূলের এক যুবনেতাও জড়িত বলে তারা জেনেছে। ওই তৃণমূল নেতার ছেলেকে আপাতত রাজারহাট-গোপালপুর এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে পুলিশের খবর।
এই তদন্তে যথেষ্ট অস্বস্তিতে এলাকার তৃণমূল শিবির। এই পরিস্থিতিতে এলাকার সিন্ডিকেটগুলির সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। বুধবার খাদ্যমন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনায় তৃণমূলের ‘পর্যবেক্ষক’ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “রাজারহাট-নিউটাউনে তৃণমূলের ‘যুবা’-র একাধিক সদস্য সিন্ডিকেটে যুক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে। এ জন্য এখানকার শাখাটিকে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, “আমাদের লোকেরা সবাই সাধু নাকি! অনেকেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। এই খুনের নেপথ্যে কারা রয়েছে, তা দেখতে হবে।” জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানিয়েছেন, চুন-বালি-সুরকির কারবার থেকে দলের লোকেদের সরতে হবে। না হলে এ ধরনের খুনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। তাঁর কথায়, “ওই এলাকায় দলের এক-আধজন নিজের ভাইদেরও ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেছেন।”
জ্যোতিপ্রিয়বাবুর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেও জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী ৩ ডিসেম্বর, শনিবার ইএম বাইপাসের তৃণমূল ভবনে উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূল কংগ্রেসের সব গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) সব দেখছেন। এক দিন সবাইকে ধরবেন। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যেতে হবে তখন!”
সিন্ডিকেট-কেলেঙ্কারির ঘটনায় যে মন্ত্রীর দিকে অভিযোগের তির, সেই পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে কি এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা হয়েছে? জবাবে জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠক ছিল। উনি তখন বলেছিলেন, কথা বলবেন। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য সময় হয়নি।” পূর্ণেন্দুবাবু অবশ্য বলেন, “এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। যা বলার মুখ্যমন্ত্রীই বলবেন।” ৩ ডিসেম্বরের বৈঠক প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।” |