নিশ্চিন্তেই বসে আছেন প্রৌঢ় একরাম।
সাকিন পানিপথের রামডা গ্রাম। পেশায় চাষি। শীতের সকালে খেতের ধারে নরম রোদ পিঠে নিয়ে বসে তদারকি করছেন, কী ভাবে ঝাড়াই-বাছাই হচ্ছে নতুন ফুলকপি। বাড়তি ডালপালা ছেঁটে কেটে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে সাজানো হচ্ছে একটি একটি করে। তখনই শুনলেন প্রশ্নটা: খুচরো ব্যবসায় তো বিদেশি লগ্নি ঢুকতে চলেছে। তা হলে আপনাদের কী হবে? শুনলেন এবং তাকালেন অবাক হয়ে। তার পর খোশমেজাজে একটা ফুলকপি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “ঘর লেকে যাইয়ে, বড়িয়া হ্যায়!”
খোশমেজাজের কারণ আছে বৈকি। বছরখানেক হল, একরামের প্রায় ৪০ একর জমিতে আর ফুলকপি পড়ে থাকে না। ট্র্যাক্টরের পিছনে ফুলকপি বোঝাই করে, এবড়োখেবড়ো রাস্তায় কসরত করতে করতে ২০ কিলোমিটার দূরের সব্জিমান্ডিতে যেতে হয় না। সেখানে গিয়ে ওজনে ঠকে আসতে হয় না। রাস্তায় ফুলকপিতে দাগ পড়ে যায় না। গ্রামে সেই ‘ফড়েদের’ উৎপাতও আর নেই। আগে ফড়ে বা দালালদের বলে দেওয়া দামে সব্জি বিক্রি করতে হত। বাজারে গেলে দেখছেন, সেই ফুলকপিই পরে তিন গুণ দামে বিকোচ্ছে। এখন খেতের দোরগোড়া থেকেই ‘কোম্পানির বাবুরা’ তাঁর ফুলকপি কিনে নিয়ে যান। বৈদ্যুতিন ওজনযন্ত্রে মাপা হয়। কত দাম পাওয়া যাবে, তা-ও আগের দিন বলে দেওয়া হয়।
বাপ-কাকার ৪০ একর জমিতে গত দশ বছর ধরে চাষ-আবাদ করছেন অনিল কুমার। মাথায় টুপি, পায়ে সস্তার স্নিকার্স, মোটামুটি শিক্ষিত। কিন্তু জ্ঞান হওয়া থেকে কোনও দিন যে মাটি পরীক্ষা হয়নি, সেটাই মাথায় আসেনি। এখন তিনি নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করান। অনিলের কথায়, “মাটিতে কীসের অভাব আছে জেনে সার দিই। ফলন বেড়েছে। আগের মতো বোতল বোতল কীটনাশক ছড়ানো মানা। গ্রামে বিজ্ঞানীরা আসেন। শাকসব্জিতে বিষ না ছিটিয়ে পোকা মারার দাওয়াই বাতলে দিয়েছেন।”
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে শ’খানেক কিলোমিটার দূরের দিল্লিতে যে ‘কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ’ চলছে, তা আর এক ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র পানিপথে এসে টের পাওয়া যায় না। উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানা সীমানায় যমুনা নদীর তীরের রামডা মহম্মদপুররাই, নাঙ্গলারাই, হায়দারপুরোর মতো সাতটি গ্রামের এটাই ছবি। ওয়ালমার্টকে উত্তরপ্রদেশে দোকান খুলতে দেবেন না বলে মায়াবতী ঘোষণা করেছেন। তাঁর রাজ্যেরই এই সব গ্রামের ছ’শো কৃষক ওয়ালমার্টের সহযোগী সংস্থা ভারতী রিটেলকে গত এক বছর ধরে সরাসরি শাকসব্জি বিক্রি করছেন। দালালরা বিদায় নেওয়ায় চাষিরাই বেশি দাম পাচ্ছেন। সেই সঙ্গে শিখে নিচ্ছেন, কী ভাবে উৎপাদন বাড়ানো যাবে, কী ভাবে জৈব সারের যত্ন করতে হবে, কী ভাবে ফুলকপির বাড়তি ডালপাতা ছেঁটে দিয়ে ওজনে কম হলেও মোটের উপর বেশি দাম মিলবে।
তাই লোকসান তো নয়ই, বরং লাভের মুখ দেখেছেন কৃষকরা। |
একরাম, অনিলের মতো কৃষকদের বক্তব্য, আগে এক জন দালাল গ্রামে এসে ঘুরে ঘুরে চাষিদের থেকে সব্জি জড়ো করতেন। সেই দালালের থেকে আর এক ব্যবসায়ী সে সব কিনে পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করতেন। পাইকারি বাজার থেকে আবার আর এক ব্যবসায়ী কিনে বাজারের সব্জি বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতেন। দালালদের এড়াতে মান্ডিতে সব্জি নিয়ে গেলেও লাভ হত না। প্রচুর সব্জি নষ্ট হত। মান্ডিতে গিয়ে ওজনে ঠকতে হত, দুর্ব্যবহার ছাড়া বেশি কিছু মিলত না। প্রায়ই বীজ-সার কিনতে এই দালালদের থেকেই ধারকর্জ করতেন চাষিরা। সেই ধার শোধ করতেও এদের কম দামে ফসল বেচতে হত। চাষিদের কপালে কম দামই জুটত। লাভের গুড় খেয়ে যেত মধ্যসত্বভোগীরা। এখন তাঁদের পিছু হঠতে হয়েছে।
মায়াবতীর দলের নেতারা এ সব যুক্তি মানতে নারাজ। যেমন মানতে নারাজ বাম-বিজেপি-সমাজবাদী পার্টির নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, এঁরা তো সব বড় চাষি। এক এক জনের কাছে ২০-৪০ একর করে জমি। এক একরে ৫০ টন করে ফসল। সে সব তো ওয়ালমার্ট কিনে নিয়ে গিয়ে ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে’ সাজিয়ে রাখবে। কিন্তু ছোট চাষি, যার কাছে ২-৩ একরের বেশি জমি নেই, তাঁর কী হবে? বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বামেদেরও একই যুক্তি। তাঁদের বক্তব্য, সে রাজ্যে জমি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত। তাই চাষিদের উৎপাদনও কম। এত কম ফসল বিকোবে কী ভাবে?
তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, হরিয়ানার সীমানাবর্তী উত্তরপ্রদেশের এই গ্রামগুলিতে জাঠদের হাতে জমির মালিকানা বেশি। ছোট জমির মালিকানা মূলত মহম্মদ দিলশাদ বা মোমিন আলির মতো সংখ্যালঘু কৃষকদের হাতে। অল্প জমিতে ধান চাষ করে লাভ হয় না। তাই ছেলেপুলে-বিবি মিলে হাত লাগিয়ে শাক-সব্জি ফলাচ্ছেন তাঁরা। তার পর? এলাকার ছোট-বড় চাষি মিলে এর মধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন ‘সোসাইটি’। দিলশাদের কথায়, “গ্রামের সব চাষি মিলে সোসাইটি হয়েছে। সোসাইটির অফিসে সব সব্জি জড়ো হয়। সোসাইটির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হয়েছে। সেখানেই টাকা এসে যায়। কৃষকদের প্রত্যেকের নামে আলাদা কার্ড রয়েছে। তাতে সব তথ্য থাকে। কে কত সব্জি বেচেছে, হিসেব থাকে। সেই অনুযায়ী টাকা পেয়ে যাই।” এই চাষিরা মুফতে বীজ, সারও পান। তার সঙ্গে রয়েছে বাড়তি বেশ কিছু পরিষেবা। যেমন, সোসাইটির অফিসেই দিনের তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা, বৃষ্টির পূর্বাভাসের খবরাখবর মেলে। সব সব্জির দাম আগের দিন লিখিত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়। এবং সর্বোপরি, আগের থেকে বেশি দামে টাটকা সব্জি কিনে নিয়ে যান কোম্পানির বাবুরা।
পানিপথের এই এলাকার সাংসদ মায়াবতীরই দলের তবাসুম বেগম। দিলশাদরা ঠিক করছেন, এর পর তবাসুম এলাকায় এলে তাঁর কাছে রাস্তা পাকা করার দাবি জানাবেন।
এই রাস্তা দিয়েই তো ‘কোম্পানির বাবুরা’ আসেন তাঁদের সব্জি কিনতে। পরে বিদেশি ‘কোম্পানির বাবুরা’ গ্রামে হিমঘর করে দিলে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের বন্দোবস্ত যাতে হয়, সেই দাবিও জানাবেন তাঁরা সরকারের কাছে।
তা হলে? জবাব একটাই। দেশজুড়ে তোলপাড় করা খুচরো-বিরোধীরা কিন্তু গোহারান হারছেন পানিপথের এই যুদ্ধে। |