সাফল্যেও দুঃখিত প্রশাসক
কিষেণজি ডেড?
আজ সন্ধ্যায় প্রগতি ময়দানের হংসধ্বনি ওপেন এয়ার থিয়েটারে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরেই দর্শকাসনের প্রথম সারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে দ্রুত সেলফোনের বোতাম টিপতে শুরু করলেন।
সামনের আলোকিত মঞ্চে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ মঞ্চস্থ করার অপেক্ষায়। নির্দেশক অভিনেত্রী অলকানন্দা রায় এসে গিয়েছেন। প্রগতি ময়দানে বাণিজ্যমেলার ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডে’-র দর্শকাসনে কিলবিল করছেন প্রবাসী বাঙালিরা। মমতাকেও কিছু ক্ষণের জন্য মঞ্চে উঠতেই হবে।
তার আগেই কলকাতা থেকে ফোনটা এল। ও-প্রান্তে সম্ভবত রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। এ-প্রান্ত থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কয়েকটা বাক্য যা শোনা গেল “আপনাদের তো বলেছিলাম, কাউকে গুলি করবেন না! মারলেন কেন?”
“ওহ্! ওরাই গুলি চালিয়েছিল? আচ্ছা, আমাকে ডিটেল্স জানান।”
তার পরেই স্বগতোক্তি, “আমি যে কোনও মৃত্যুর বিরুদ্ধে। মনটা খারাপ হয়ে গেল! আমি ওদের বলেছিলাম, গুলি করবেন না। জীবন্ত গ্রেফতার করুন। আমি চাই, কাউকেই যেন গুলি না-করা হয়। যদি ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়ে-সুজিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়! কিন্তু এখন তো শুনছি, ওরাই আগে গুলি চালিয়েছিল! এ-দিক থেকে তো প্রাণ বাঁচাতে গুলি করতে হয়েছে!”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় মমতা।
বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই
মঞ্চ থেকে ফিরে এসে আবার যখন তিনি দর্শকাসনে, তত ক্ষণে গোটা চত্বর জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যারিকেডের বাইরে ভিড় তৈরি হয়েছে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের। অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডের নিরাপত্তাবাহিনী যাঁকে নিয়ে নাজেহাল, সেই কিষেণজি নিহত যাঁর রাজ্যে, আজকের দিনে তো তাঁকে ছাড়া যায় না! মুখ্যমন্ত্রী মমতার অন্তত একটা ‘উদ্ধৃতি’ চাই। মমতা অবশ্য তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। কয়েকটা আসন দূরে বসে-থাকা রেলবোর্ডের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করছেন, “এর পর ওরা (মাওবাদীরা) জঙ্গলমহলের রাতের ট্রেনগুলোর উপর হামলা চালাতে পারে। আপনি দ্রুত ব্যবস্থা নিন। দরকার হলে বাড়তি নিরাপত্তাবাহিনী দিন। দূরপাল্লার ট্রেন তো বটেই, লোকাল ট্রেনেও নিরাপত্তা বাড়ান অবিলম্বে।”
রেলবোর্ডের চেয়ারম্যানকেও দেখা গেল সেলফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে।
দুপুরের পর বাণিজ্যমেলার প্রেক্ষাগৃহে শিল্পদ্যোগীদের কাছে ‘রাইজিং বেঙ্গল’ শীর্ষক সভায় মুখোমুখি প্রশ্নোত্তর। সন্ধ্যায় ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ দর্শন। এবং রাতে রাজধানীতে কর্মরত বঙ্গ-ক্যাডারের আমলাদের জন্য দলের নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ের দেওয়া নৈশভোজে যোগদান এই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি। তার মধ্যেই আচম্বিতে কিষেণজির খবর! যাকে মমতার ঘনিষ্ঠরা ‘সরকারের বিরাট সাফল্য’ বলেই বর্ণনা করছেন। পাশাপাশি বলতে চাইছেন মমতার ‘রাজনৈতিক সাফল্যে’র কথাও। বলছেন, সাবেক সরকারের আমলে যা করা যায়নি, সরকারে আসার ছ’মাসের মধ্যে মমতা তা করে দেখালেন!
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো ‘মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়ার’ হুমকি মমতা দেননি। বরং সরকারের ‘অর্থনৈতিক সঙ্কট’ সত্ত্বেও জঙ্গলমহলে উন্নয়নের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। একাধিক বার নিজে সেখানে গিয়েছেন। প্রশাসনের একাংশের ‘অনুযোগ’ উপেক্ষা করেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজে উদ্যোগী হয়ে জঙ্গলমহলের ১০ হাজার ছেলেমেয়েকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। একই সঙ্গে শুরু করেছেন মাওবাদীদের ‘রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন’ করার প্রক্রিয়াও। দলের একাংশের ‘মৃদু আপত্তি’ সত্ত্বেও মধ্যস্থতাকারীদের মারফৎ শান্তি-প্রক্রিয়া জারি রেখে গিয়েছেন। মাওবাদীদের হুমকি প্রকাশ্যে ‘অবজ্ঞা’ করেছেন। মধ্যস্থরা বেঁকে বসলেও তাঁদের মহাকরণে ডেকে পাঠিয়ে শান্তি-আলোচনা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন।
কিন্তু একই সঙ্গে ‘প্রশাসনিক প্রক্রিয়া’ও চালিয়ে গিয়েছেন। মমতার ঘোষিত নীতি ছিল মাওবাদীরা অস্ত্র ছেড়ে মূলস্রোতে ফিরে এলে তাদের ভার সরকার নেবে। কিন্তু জঙ্গলমহলে সাধারণ মানুষ খুন হলে বা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর গুলি চালালে প্রশাসন চুপ করে থাকবে না।
সমান্তরাল ভাবে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া চালিয়েই ‘প্রশাসক’ মমতার এই ‘সাফল্য’ বলে মনে করছেন তাঁর দলের নেতারা।
আজ রাজ্য প্রশাসনের তরফে মমতাকে জানানো হয়েছে, কিষেণজি-সহ মাওবাদীদের একটি দল গত দু’দিন ধরে ওই এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, বেশ কিছু বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনিক কর্তাকে খুন করে রাজ্য সরকারকে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া। এর মধ্যেই খবর পেয়ে কিষেণজিদের ঘিরে ফেলে বাহিনী। চারটি বৃত্তে ঘিরে ফেলে তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু মাওবাদীরা গুলি চালায়। বাহিনীও পাল্টা গুলি চালায়। সেই গুলিবৃষ্টিতে সাধারণ গ্রামবাসীদেরও মৃত্যু হতে পারত। তাঁদের এবং নিজেদের বাঁচাতেই বাহিনীও গুলি চালায়। সেই গুলির লড়াইয়েই কিষেণজি নিহত হন। আহত হন শশধর মাহাতোর স্ত্রী সুচিত্রা সহ আরও কয়েক জন। বস্তুত, মমতা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, পারলে সুচিত্রাকে আহত অবস্থাতেই গ্রেফতার করতে। বাকি যারা আহত হয়েছে, তাদেরও দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।
মমতা নিজে আজ প্রকাশ্যে তাঁর ‘সাফল্য’ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। বরং তিনি খোঁজ নিয়েছেন, কলকাতায় মাওবাদীদের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ বিশিষ্ট জনেরা কেউ কিছু বলেছেন কি না। এবং ঘনিষ্ঠ মহলে বার বারই বলেছেন, তিনি যে কোনও মৃত্যুরই বিরোধী (ঘটনাচক্রে, লালগড়ের সভায় দাঁড়িয়ে মাওবাদী নেতা আজাদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত চেয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা)। দলের নেতাদের একাংশ আজকের ঘটনার ‘উল্লসিত’ হলেও দৃশ্যতই মমতা নিজে কিন্তু ‘সংযত’। যিনি এখনও জানেন, সমস্যার শেষ এখানেই নয়। এখনও চান, অস্ত্র ছেড়ে মাওবাদীরা মূলস্রোতে ফিরে আসুক।
প্রসঙ্গত, আজকের ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমও ফের মাওবাদীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অস্ত্র ছেড়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের মূল স্রোতে ফিরে আসার জন্য। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “কিষেণজি নিহত বলে শোনা যাচ্ছে। তাঁর পরিবার এবং অনুগামীদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। কিষেণজি গ্রেফতার হলেই খুশি হতাম। তাঁর অনুগামীদের বলছি, ভুল পথ থেকে সরে আসুন। তথাকথিত মাওবাদী আন্দোলনের পিছনে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মদত রয়েছে। মাওবাদীরা সত্যিই বামপন্থী হলে অস্ত্র ছেড়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের মূল স্রোতে ফিরে আসুন।”
তৃণমূল নেত্রীকে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চান, এই মর্মে কিষেণজির বক্তব্যকে বরাবরই মমতা-মাওবাদী যোগসাজশের ইঙ্গিত বলে প্রচার করেছে সিপিএম। সেই মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের জমানাতেই কিষেণজির নিহত হওয়া কি ‘অদ্ভুত পরিহাস’ নয়? সূর্যবাবু বলেন, “আজ ওই রাজনৈতিক আলোচনায় ঢুকতে চাই না। সরকারকে বলব, আত্মতুষ্টির কোনও কারণ নেই। নিরবচ্ছিন্ন লড়াই জারি রাখতে হবে। মাওবাদী মোকাবিলার বহুমাত্রিক কৌশল অব্যাহত রাখতে হবে।” এই ঘটনা কি মমতার রাজত্বের বড় সাফল্য? বিরোধী দলনেতার কথায়, “কিষেণজি মারা গিয়েছেন বলেই আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার কিছু নেই।
এটা কোনও ব্যক্তির বিষয় নয়। এই ঘটনায় সমস্যাটি মিটেও গেল না।”
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, তিনি নিজেও ‘অন্যরকম’ ভাবছেন না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.