|
|
|
|
ভাঙল প্রতিরোধ, জখম সুচিত্রা-সহ বাকি সঙ্গীরা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
আক্রমণ শানানোর জন্য যে জঙ্গল ছিল তাঁর ‘নিরাপদ’ আশ্রয়, সেই জঙ্গলের ভিতরেই যৌথ বাহিনীর চক্রব্যূহে বরাবরের মতো ‘বন্দি’ হয়ে গেলেন মাওবাদীদের অন্যতম শীর্ষ নেতা কিষেণজি। তবে তাঁকে জীবিত ধরা যায়নি। পুলিশের দাবি, বৃহস্পতিবার বিকেলে বিনপুরের বুড়িশোল জঙ্গলের ভিতরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ের পরে যে গুলিবিদ্ধ দেহটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি কিষেণজি-রই। গত প্রায় তিন বছর ধরে জঙ্গলমহলে যে ‘জনগণ’-কে নিয়ে তিনি লড়াই চালাচ্ছেন বলে বার বার দাবি করে এসেছেন, সেই জনগণের একাংশই মাওবাদীদের এই শীর্ষ নেতার অবস্থান জানিয়ে দেয়। বিপদ বুঝে এ বারেও পালিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আগেই ঘিরে ধরে তাঁর সমস্ত পালানোর রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানেরা।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, বৃহস্পতিবার ২০ মিনিটের গুলির লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি। পুলিশের দাবি, অভিযানের সময়ে কিষেণজির সঙ্গে ছিলেন মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতো-সহ আরও অন্তত পাঁচ-ছ’জন। আইজি পশ্চিমাঞ্চল গঙ্গেশ্বর সিংহ বলেন, “গুলির লড়াইয়ে যিনি মারা গিয়েছেন, তিনি কিষেণজি বলেই আমরা জানতে পেরেছি। তবে ধৃত অথবা আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের দিয়ে শনাক্ত করানোর পরেই আমরা এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত করে বলব।” যদিও মাওবাদী ঘনিষ্ঠ ভারভারা রাও-এর সন্দেহ, ‘গত কাল (বুধবার) কিষেণজিকে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আটক করে যৌথ বাহিনী এবং তার পরে তাঁকে মেরে ফেলা হয়’। ভারভারা রাওয়ের কথায়, “তার পরে গুলির লড়াইয়ের একটা গল্প ফাঁদা হয়েছে!”
মহাকরণ সূত্রে খবর, ধৃত মাওবাদী নেতা তেলুগু দীপককে শুক্রবারেই পাঠানো হচ্ছে কিষেণজির দেহ শনাক্তকরণের জন্য। ভারভারা রাও অবশ্য দাবি জানিয়েছেন, কিষেণজির দাদার মেয়ে দীপাকে দিয়ে দেহ শনাক্ত করা হোক। তাঁর বক্তব্য, কিষেণজির বৃদ্ধা মা ক্যানসারে আক্রান্ত। দাদাও খুবই অসুস্থ। তাই তাঁদের পক্ষে শনাক্ত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় বলেন, “মৃতদেহের সঙ্গে পাওয়া একে-৪৭ এবং কানে শোনার যন্ত্র (হিয়ারিং এড) দেখে মনে করা হচ্ছে সেগুলি কিষেণজির।”
সুচিত্রা মাহাতো-সহ কিষেণজির সঙ্গী বাকি মাওবাদীদের অবশ্য বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ধরা যায়নি। পুলিশের দাবি, গুলির লড়াইয়ে আহত হয়েছেন সুচিত্রা। তিনি ও দলের বাকিরা রাত পর্যন্ত লুকিয়ে ছিলেন জঙ্গলে। পুলিশ জানিয়েছে, সুচিত্রার সঙ্গে একটি বাচ্চা রয়েছে। তাই জঙ্গল ঘিরে থাকলেও পুলিশ সরাসরি তাঁকে লক্ষ করে গুলি চালাতে পারেনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন দিল্লিতে। তাঁকে বারে বারেই ঘটনার কথা জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, সম্ভব হলে যেন গুলি না চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় সুচিত্রা ও দলের বাকিদের। প্রধানত মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই রাতে জঙ্গলে মাইক নিয়ে পুলিশ সুচিত্রাকে বারবার আত্মসমর্পণ করতে বলেছে। এমনকী ঘোষণায় আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, আত্মসমর্পণ করলে তাঁর ও দলের বাকিদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হবে।
কিন্তু পাল্টা জবাবে মাওবাদীদের তরফে গুলি ছুটে আসায় রাতেই ফের লড়াই শুরু হয়। ঘুটঘুটে অন্ধকার ফুঁড়ে জঙ্গল থেকে ঘন ঘন গুলির শব্দ ভেসে আসে। তবে লড়াইয়ের জায়গার কাছাকাছি কাউকেই যেতে দেওয়া হচ্ছে না। গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে যৌথ বাহিনী।
পুলিশ জানাচ্ছে, মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজি পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতে দলের তরফে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের সদস্যও ছিলেন তিনি। অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশ তাঁর
মাথার দাম ২০ লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছিল। এ রাজ্যে যৌথ বাহিনীর হাতে কিষেণজির মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে মাওবাদী-বিরোধী অভিযানে সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে। তবে পাশাপাশি দেশের ন’টি মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যকে সরাসরি সতর্ক করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, সংগঠনের তিন নম্বর নেতার মৃত্যুর বদলা হিসেবে যে কোনও সময়ে আঘাত হানতে পারে মাওবাদীরা। জঙ্গলমহল এলাকায় ট্রেন লাইন ও স্টেশন সুরক্ষিত করতে বিশেষ বাহিনী নামিয়েছে রেল।
রাজ্য পুলিশের ডিজি জানিয়েছেন, গত দু’দিন ধরেই যৌথ বাহিনীর গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসছিল জঙ্গলের ভিতরে মাওবাদীদের একটি বড় স্কোয়াড লুকিয়ে রয়েছে। সেখানে কিষেণজি, সুচিত্রা মাহাতোর মতো প্রথম সারির মাওবাদী নেতা-নেত্রীরা আছেন। তাঁরা যৌথ বাহিনীর উপর বড় ধরনের হামলার ছক কষছেন। পুলিশ তখনই গোপনে তাঁদের ধাওয়া করতে শুরু করে। তার পরেই শুরু হয় দু’পক্ষের লড়াই। যার পরিণতি আজ কিষেণজির মৃত্যু। তবে সুচিত্রা-সহ বাকিদের ধরতে না পারাটাও মাথায় রেখেছে যৌথ বাহিনী। মাওবাদী দমন অভিযান আরও জোরদার করতে আজ, শুক্রবার ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন সিআরপি-র ডিজি কে বিজয়কুমার।
পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠিকে গভীর রাতে ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, “বাকিদের খোঁজে রাতেও অভিযান চলছে। আজ রাতে মৃতদেহটি এই এলাকা থেকে সরানো সম্ভব হবে না। শুক্রবার সকালে আমরা মৃতদেহ ঝাড়গ্রামে পাঠিয়ে দেব।”
কী ভাবে যৌথ বাহিনীর কব্জায় এলেন কিষেণজি? পুলিশ জানাচ্ছে, ঝাড়গ্রাম থেকে কিছু দূরের কুশবনির জঙ্গলে কিষেণজি, সুচিত্রা, বিকাশের মতো নেতানেত্রীরা লুকিয়ে রয়েছেন বলে মঙ্গলবার রাতে খবর আসে। দশ কোম্পানি পুলিশ-আধাসেনা মিলে কুশবনির জঙ্গল ও লাগোয়া গ্রামগুলি ঘিরে ফেলে। বুধবার ভোরে মাওবাদীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হয় যৌথ বাহিনীর। দিনভর তল্লাশি অভিযান চলে। কিন্তু দিনের শেষে সেই খালি হাতেই ফিরতে হয় বাহিনীকে। এক পুলিশ-কর্তা জানান, এলাকার ভূগোল সম্পর্কে ধারণা পুরোপুরি নিখুঁত না হওয়ায় জঙ্গলপথে দু’টি পালানোর পথ চিহ্নিত করা যায়নি। তবে অভিযান বন্ধ করা হয়নি।
বুধবার রাতেই কুশবনি থেকে যৌথ বাহিনীর নজর ঘোরে জামবনির বুড়িশোলের দিকে। পুলিশ-আধাসেনার প্রায় ১০ কোম্পানি বাহিনী বুড়িশোলের জঙ্গল ঘিরে ফেলে। পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার ভোরে ফের মাওবাদী-বাহিনী গুলি বিনিময় হয়। পুলিশ নিশ্চিত হয়ে যায়, কুশবনিতে তাড়া খাওয়া মাওবাদীরা বুড়িশোলেই ঘাঁটি গেড়েছে। বুড়িশোলের জঙ্গলঘেরা গ্রামে জনৈক ধর্মেন্দ্র মাহাতোর ঘর ছেড়ে আরও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে গিয়ে জঙ্গলের ভিতরে যৌথ বাহিনীর বন্দুকের আওতায় এসে যান কিষেণজি।
পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ জঙ্গলের ভিতরে যৌথ বাহিনীর একটি দল কিষেণজিদের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। বাহিনীকে আসতে দেখে মাওবাদীরা গুলি চালায়। এতে আরও সুবিধা হয়ে যায় বাহিনীর। ঠিক কোন জায়গায় কিষেণজিরা লুকিয়ে রয়েছেন, তা চিহ্নিত করা হয়। শুরু হয় পাল্টা গুলি। পুলিশ সূত্রে খবর, মাত্র ২০ মিনিটেই ভেঙে পড়ে মাওবাদীদের প্রতিরোধ। গুলির লড়াইয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান কিষেণজি।
গত বছর ২৫ মার্চ শালবনির লক্ষ্মণপুরের জঙ্গলেও কিষেণজিকে প্রায় নাগালের মধ্যে পেয়ে গিয়েছিল যৌথ বাহিনী। কিন্তু প্রবল গুলিযুদ্ধের পরে সে বারেও অধরা থেকে গিয়েছিলেন মাওবাদী নেতা। তবে কিষেণজি সে দফায় আহত হয়েছিলেন বলেই দাবি জেলা পুলিশের। বস্তুত, ওই ঘটনার পর মাস ছয়েক ধরে কিষেণজি-র গতিবিধি সম্পর্কে খানিক অন্ধকারেই ছিল পুলিশ। খবর মিলছিল, আহত কিষেণজি-র চিকিৎসা চলছে ছত্তীসগঢ়ের জঙ্গলে। কখনও বা শোনা গিয়েছে, মাওবাদী এই শীর্ষ নেতা রয়েছেন ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে।
বুড়িশোলের জঙ্গলের এক দিকে ঝাড়খণ্ড সীমানা। কিন্তু বুধবার থেকে যৌথ বাহিনী এমন সাঁড়াশির মতো সেই জঙ্গল ঘিরে ফেলেছিল যে, ঝাড়খণ্ডের দিকেও পালাতে পারেননি কিষেণজি। জানা গিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গলমহলের অভিযানে গণ জাগরণ মঞ্চের সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিলেন। সম্প্রতি গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ কমে এসেছিল। উল্টে গ্রামবাসীদের কাছ থেকেই মাওবাদী শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে নিয়মিত খবর আসছিল যৌথ বাহিনীর কাছে। পুলিশের একাংশের মতে, বুধবার সকালেই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছিলেন কিষেণজি এবং তিনি বুড়িশোলের জঙ্গলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে খবর পৌঁছে যায় তাঁদের কাছে। আর তখনই শুরু হয় অভিযান।
প্রতি দিন যেখানে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে, তখন কেন আচমকা পশ্চিমবঙ্গে আসতে গেলেন কিষেণজি? গোয়েন্দাদের অনুমান, শান্তি প্রক্রিয়ায় সংগঠনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, প্রধানত তা ঠিক করতেই এ রাজ্যে এসেছিলেন কিষেণজি। যৌথ বাহিনীর অভিযান হলে অনায়াসে ঝাড়খণ্ডের দিকে সরে যেতে সুবিধা হবে ধরে নিয়েই বাছা হয়েছিল বুড়িশোলের জঙ্গল। |
|
|
|
|
|