শিল্প থেকে সঙ্গীত দুনিয়া।
বলিউড। টলিউড। কলিউড। আরও যা যা আছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহল। মুম্বই ক্রিকেট মহল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রঞ্জি ট্রফি নিয়ে ব্যস্ত ঘরোয়া ক্রিকেটারের দল।
সতীর্থ ক্রিকেটার। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক।
হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতা। সিনিয়র পুলিশ অফিসার।
আমজনতা।
শহর মুম্বইতে বসে মনে হচ্ছে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী মিশে যাচ্ছে এক প্রার্থনা আর আকুতিতে। সকলের চোখ শুক্রবারের ওয়াংখেড়ের ওপর। আর ৩৩ রান করিয়ে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরির বিজয়-তোরণ উড়িয়ে দাও বিশ্বকাপ জয়ের মাঠে!
শুধু ওয়াংখেড়েতে প্রথম তিন দিন কেন, চলতি সিরিজে এক বারের জন্যও ক্রিকেটের এমন রমরমা বাজার দেখা যায়নি। উল্টে ফাঁকা মাঠ দেখতে দেখতে আশঙ্কা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ক্রিকেট না রুগ্ন শিল্প হয়ে যায়! সেই আতঙ্ক পাকাপাকি ভাবে দূর হবে কি না সেটা সময় বলবে। কিন্তু হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো সচিন তেন্ডুলকর যে সাময়িক ভাবে জনতার ঢল ফিরিয়ে আনছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
|
এখানকার নিয়ম হচ্ছে, দিনের খেলা শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে থেকে পরের দিনের দৈনিক টিকিট বিক্রি শুরু হবে। এ দিন চারটের সময় মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা চতুর্থ দিনের টিকিট বিক্রি করা শুরু করল। সচিন ততক্ষণে হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে গিয়েছেন। টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে থেকেই। তিন ঘণ্টার মধ্যে সব টিকিট নিঃশেষ। জনতার এমন বাঁধনহারা অবস্থা হালফিলে আর এক বারই দেখা গিয়েছে। ২ এপ্রিল সচিনরা যখন বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামছিলেন।
সেলিব্রিটি কারা কারা আসছেন? মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার কর্তারা রাত পর্যন্ত চূড়ান্ত তালিকা হাতে পাননি। তবে নাসিরুদ্দিন শাহ, সুনীল শেঠিদের এ দিনই মাঠে দেখা গিয়েছে। শুক্রবার আরও জনপ্রিয় কিছু মুখ ওয়াংখেড়ের জায়েন্ট স্ক্রিন বা টিভি-র পর্দায় ভেসে উঠলে অবাক হওয়ার থাকবে না। কেউ বলছেন, মুকেশ অম্বানী আসবেন। কেউ বলছেন, অভিষেক বচ্চন আসতে পারেন। কেউ খোঁজ নিচ্ছেন, শাহরুখ খান কি মুম্বইতে আছেন?
শুনতে শুনতে মনে হবে কোনও এক রাহুল শরদ দ্রাবিড় সত্যি কী নিষ্ঠুর কপালের লিখন নিয়ে ক্রিকেট পৃথিবীতে এসেছেন! এ দিন সচিন ক্রিজে এসে মিনিট দশেক কাটাতে না কাটাতে দ্রাবিড় দু’বার ব্যাট তুলে ফেলেছেন। প্রথমে টেস্টে তেরো হাজারের মাইলস্টোন পেরলেন। সচিন ছাড়া যে কৃতিত্ব ইহজগতে আর কারও নেই। তাও আবার কী? টেস্ট সংখ্যার বিচারে তিনি সবথেকে তাড়াতাড়ি তেরো হাজারের গ্রহে ঢুকে পড়লেন। ইনিংসের সংখ্যার বিচারে যদিও সচিন এগিয়ে। তাঁর লেগেছিল এগারো ইনিংস কম। কিছুক্ষণ পর চলতি বছরে হাজার রান করে ফেলা। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে পাঁচটা সেঞ্চুরি। আজকেরটা মাত্র ১৮ রানের জন্য না হারালে ষষ্ঠ সেঞ্চুরিটাও হয়ে যায়।
চা-পানের ঠিক আগের বলে অদ্ভুত ভাবে আউট হয়ে বাঁচলেন দ্রাবিড়। ব্যাটে লেগে বল উইকেটের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল। ফুটবলারের মতো স্কিলে গোললাইন সেভ করলেন। কিন্তু ষষ্ঠ সেঞ্চুরিটা এর পরেও হল না। এমন আফশোস করতে করতে মাঠ ছাড়লেন যে, দেখে মনে হচ্ছিল সেঞ্চুরি হাতছাড়া করে আসায় সারা রাত ঘুমোতে পারবেন না। সন্ধ্যাবেলায় শিবনারায়ন চন্দ্রপলের সঙ্গে ডিনারে বেরনোর সময় যদিও কিছুটা স্বাভাবিক লাগল। মনে হল অনেকটা সামলে উঠেছেন। |
কিন্তু এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে হাজারের ওপর রান, তেরো হাজারের শৃঙ্গ জয়ের দিনেও দ্রাবিড় থেকে গেলেন সেই অকথিত নায়ক। দিনের শেষে যাবতীয় আলোচনা আর জল্পনার কেন্দ্রে সচিন তেন্ডুলকর। দ্রাবিড়ীয় মনঃসংযোগটা আজ যাঁর ব্যাটিংয়ে চোখে পড়ছিল। দেবেন্দ্র বিশুকে পুল মারতে গিয়ে দু’বার উইকেট দিয়েছেন। পুল শটটা ছেঁটে ফেললেন। তা বলে রক্ষণাত্মক হয়ে গিয়ে নয়। বিশুর জন্য নতুন অস্ত্র বের করলেন লেট কাট। আর ফিডেল এডওয়ার্ডসকে থার্ডম্যানের ওপর দিয়ে আপার কাট মারলেন। যা সচিন মেরেছিলেন শোয়েব আখতারকে ২০০৩ বিশ্বকাপের সেই বিখ্যাত সেঞ্চুরিয়ন ম্যাচে। ৫৮ রানের মাথায় তবু ওয়াংখেড়ের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম ছিল। যখন তেন্ডুলকরের ব্যাট ছুঁয়ে উইকেটকিপারের কাছে নীচু ক্যাচ গেল। ভাগ্য ভাল যে, কালর্টন বাগ সেটা ফেললেন। বোলারের নাম? সেই দেবেন্দ্র বিশু। ঘাতক স্পিনারের ফাঁড়া কাটিয়ে তিনি যে এখনও ক্রিজে আছেন সেটাকে অনেকে শুভলক্ষণ হিসেবে ধরছে। আর একটা শুভলক্ষণ নাকি এখন পর্যন্ত এই ইনিংসে কোনও ভারতীয় সেঞ্চুরি করেননি। যা দেখে ওয়াংখেড়ে আদি-দৈবিক ব্যাপারে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে যে, সেঞ্চুরিটা এ বার সচিন তেন্ডুলকরের জন্য বরাদ্দ।
তেমনই আলোচনা চলছে যে, এ দিন থাপ্পর খেয়ে বিতর্কে পড়া শরদ পওয়ার শুক্রবার মাঠে আসতে পারেন কি না। মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্ট এখন পওয়ার নন, বিলাসরাও দেশমুখ। কিন্তু পওয়ারের সঙ্গে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক। এমসিএ নির্বাচনে পওয়ার-গোষ্ঠী বিলাসরাওকে সমর্থন করেছিল। যেটা না হলে তাঁর পক্ষে জেতা সম্ভব ছিল না বলে অনেকে মনে করেন।
পওয়ার-ঘনিষ্ঠ মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার এক কর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, বিতর্কের ঝড়ের মধ্যে থাকা কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন, আসতেও পারেন।
সব মিলিয়ে দেখে মনে হবে যেন মহাষষ্ঠীর আগের রাত। মণ্ডপসজ্জার শেষ পর্ব চলছে। প্রতিমা বসে গিয়েছে। শেষ তুলির টান দেওয়ার জন্য শিল্পী হাজির। মহাযজ্ঞের সরঞ্জাম গোছগাছ করা চলছে। পুরোহিত ডাকা হয়ে গিয়েছে। ঢাকি এসে গিয়েছে। ফুল, বেলপাতা, কাঁসরঘণ্টা সব রেডি।
অধীর আগ্রহে শুধু অপেক্ষা এখন সেই মহালগ্নের!
|
ওয়াংখেড়ের স্কোর |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
(প্রথম দিন ৫৭৫-৯) |
এডওয়ার্ডস ন.আ. ১১
বিশু বো অশ্বিন ১২
অতিরিক্ত ২৬
মোট ৫৯০।
পতন: ১৩৭, ১৫০, ৩১৪, ৪৭৪, ৫১৮, ৫২৪, ৫৪০, ৫৬৩, ৫৬৬।
বোলিং: ইশান্ত ৩২-৯-৮৪-১, বরুণ ২৮-৪-১০৬-৩, প্রজ্ঞান ৪৮-১০-১২৬-১,
অশ্বিন ৫২.১-৬-১৫৬-৫, সহবাগ ১৬-১-৬১-০, কোহলি ২-০-৯-০, সচিন ৬-০-২৪-০। |
ভারত |
গম্ভীর ক বাও বো রামপল ৫৫
সহবাগ বো স্যামি ৩৭
দ্রাবিড় বো স্যামুয়েলস ৮২
সচিন ব্যাটিং ৬৭
লক্ষ্মণ ব্যাটিং ৩২
অতিরিক্ত ৮
মোট ২৮১-৩।
পতন: ৬৭, ১৩৮, ২২৪।
বোলিং: এডওয়ার্ডস ১৫-০-৭০-০, রামপল ১২-১-৪২-১, স্যামি ২২-৩-৬৭-১,
স্যামুয়েলস ১১-০-৪৮-১, বিশু ২০-৪-৫৩-০। |
|
|