মায়ানমারের বর্তমান শাসকরা গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করিয়াছেন। জঙ্গি জমানায় যে-সব স্বৈরাচারী আইনকানুন ছিল, ধাপে-ধাপে সেগুলির সংশোধন করিতেছেন। বিরোধী নেত্রী আঙ সান সু চি-কে ভোটে লড়ার অধিকার ফিরাইয়া দিয়াছেন, সংবাদপত্রের উপর হইতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করিয়াছেন, আড়াইশো রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে, অবশিষ্টদেরও মুক্তির প্রতিশ্রুতি মিলিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে সংগ্রামরত জনজাতীয় সংগঠনগুলির সহিত যুদ্ধ-বিরতি করিয়া শান্তি-আলোচনা চলিতেছে, মাদক তৈয়ারকারী পোস্ত-র ৬ হাজার হেক্টর বেআইনি আবাদ ধ্বংস করিয়া দেওয়া হইয়াছে। সংসদে আইন করিয়া প্রতিবাদ আন্দোলনের অধিকার নাগরিকদের ফিরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। বছরখানেক আগেও যে-দেশ নিরবচ্ছিন্ন সামরিক স্বৈরাচারের ঘাঁটি ছিল, সেখানে এতগুলি সংস্কারের প্রক্রিয়া মায়ানমারের প্রতিবেশী দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রাষ্ট্রগুলিতে ব্যাপক ভাবে অভিনন্দিত হইয়াছে। এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইয়াঙ্গনের বিরুদ্ধে জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বিবেচনা করিতেছে।
আগামী সপ্তাহেই মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন তিন দিনের সফরে মায়ানমার আসিতেছেন। গত অর্ধ শতাব্দীতে এমন ঘটনা ঘটে নাই। লক্ষ্য গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রক্রিয়াটিকে আরও জোরালো ও অপরিবর্তনীয় করিয়া তোলা। তৃতীয় বিশ্বের সামরিক স্বৈরতন্ত্রগুলির প্রায়শই গণতান্ত্রিক সংস্কারের আশা জাগাইয়াও আবার স্বৈরাচারের খোলসেই ঢুকিয়া পড়ার প্রবণতা আছে। বর্তমান শাসকরাও যে সে পথে হাঁটিবেন না, নিশ্চয়তা কী? এই শাসকরা সামরিক জেনারেলদের আশীর্বাদ লইয়াই নির্বাচনে যোগ দিয়াছিলেন। সু চি বা তাঁহার দলকে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে দেওয়া হয় নাই। সু চি নিজে অবশ্য এই শাসকদের উপর আস্থা রাখারই পক্ষপাতী। তিনি পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে অনুরোধ করিয়াছেন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলিয়া লইতে, যেহেতু তাহাতে মায়ানমারের জনসাধারণেরই দুর্ভোগ অসহনীয় হইয়াছে। মার্কিন প্রশাসন বিশেষত প্রেসিডেন্ট ওবামার আশাবাদে তাই সতর্কবাণীও উচ্চারিত হইয়াছে। আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলি অবশ্য প্রতিবেশীর এই দিশা-পরিবর্তনে খুশি। জাপান ইতিমধ্যেই তাহার ঋণের ডালি লইয়া হাজির। মায়ানমারের সমৃদ্ধ তৈলভাণ্ডার ও বনজ সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতায় চিন তো আগে হইতেই আসরে অবতীর্ণ। এই অবস্থায় ভারত যাহাতে পিছনে পড়িয়া না থাকে, তাহা নিশ্চিত করা জরুরি।
ভারতের সহিত দীর্ঘ স্থলভূমির সীমান্ত সত্ত্বেও নয়াদিল্লি মায়ানমারের জঙ্গি শাহিকে অগণতান্ত্রিক গণ্য করিয়া দীর্ঘ কাল মুখ ঘুরাইয়া ছিল। তবে কিছু কাল আগে হইতেই আদর্শবাদ-বিমুক্ত জাতীয় স্বার্থকে পররাষ্ট্র নীতির কষ্টিপাথর রূপে শনাক্ত করিতে পারায় নয়াদিল্লি প্রতিবেশীর সামরিক শাসকদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়িয়া তোলে। বোধোদয় একটু বিলম্বিত হইলেও ইয়াঙ্গনের শাসকদের কাছে নয়াদিল্লির গুরুত্ব তাই উপেক্ষণীয় নয়। এখন যাহা দেখিবার, তাহা হইল, প্রতিবেশীর সহিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেবল শুভেচ্ছা সফর বিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে, নাকি পরিকাঠামো নির্মাণ, বাণিজ্যিক লেনদেন ও আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হইবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমৃদ্ধ অর্থনীতিগুলির সহিত সংযুক্ত হইতে গেলে ভারতকে মায়ানমারের ভিতর দিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে। বাংলাদেশের পর মায়ানমারের সঙ্গেও নিবিড় সখ্য স্থাপিত হইলে গোটা এলাকাটির আর্থিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হইবে। চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও যদি মায়ানমারে হামলাইয়া পড়ে, তবু ভৌগোলিক নৈকট্য, অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নয়াদিল্লি-ইয়াঙ্গন অক্ষ গড়িয়া উঠিতে পারে। ভারতীয় রাজনীতিকরা কি এই সম্ভাবনাটির প্রতি সজাগ রহিয়াছেন? |