আপত্তি উড়িয়ে খুচরোয় বিদেশি লগ্নি
র্থিক সংস্কারের পথে সব থেকে বড় পদক্ষেপ করল মনমোহন সিংহের সরকার।
কেন্দ্র আজ বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার দরজা বহুজাতিকগুলির জন্য খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই ক্ষেত্রে ৫১% বিদেশি লগ্নির অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। পাশাপাশি, এক ব্র্যান্ডের পণ্যের খুচরো ব্যবসায় এত দিন ৫১% বিদেশি লগ্নির অনুমতি ছিল। তা বাড়িয়ে ১০০% করা হল।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়া হলে কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আঘাত লাগবে, এই যুক্তিতে বিজেপি এবং বামেরা বরাবরই এর বিরোধিতা করছে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, শরিক তৃণমূল এবং ডিএমকে-ও এই সিদ্ধান্তের বিরোধী। মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, “দাঁতে দাঁত চেপে আমরা এর ২০০ শতাংশ বিরোধিতা করব।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘আমরা কৃষকদের পক্ষে। তাঁদের মুখে হাসি ফুটলেই দেশের মুখে হাসি ফুটবে।”
অন্য দিকে কেন্দ্রের তরফেও মমতাকে বোঝানোর সব রকম চেষ্টা হয়। আজ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনাসভায় গিয়েছিলেন শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের ঘণ্টাখানেক আগে যত ক্ষণ ওই সভা চলেছে, তত ক্ষণ মমতার সঙ্গে নিচু স্বরে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। তৃণমূল সূত্রের খবর, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে মমতাকে একটি নোট দেন আনন্দ। তিনি পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি টানার চেষ্টা করবেন বলেও জানান। আনন্দ মমতাকে বোঝান, কেন্দ্র বিদেশি লগ্নির অনুমতি দিলেও খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার থাকবে রাজ্য সরকারের। কৃষক বা ছোট ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায় ‘রক্ষাকবচ’ তৈরির অধিকারও থাকবে। বাণিজ্য মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, শুধু শরিক দল নয়, কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্বেগ দূর করতেও এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এর পরেও দীনেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকেও বিরোধিতা করেছিলেন বলেই তৃণমূল সূত্রের দাবি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকায় বিদেশি লগ্নির প্রস্তাব অনুমোদন পেয়ে যায়। তবে দীনেশ লিখিত ভাবে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বৈঠক শেষে মমতা অসন্তোষ প্রকাশ করে জানান, তৃণমূলের তরফ থেকে এর তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছিল। আগামী দিনেও তাঁরা এর বিরোধিতা করবেন। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত মানছি না। যা বলার, সংসদে দলের তরফে বলা হবে।” মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তে সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন নেই। তবে বৈঠক শেষে মমতা অসন্তোষ প্রকাশ করে জানান, তৃণমূলের তরফ থেকে এর তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছিল। আগামী দিনেও তাঁরা এর বিরোধিতা করবেন। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত মানছি না। যা বলার, সংসদে দলের তরফে বলা হবে।” মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তে সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন নেই। তবে সংসদে আলোচনা চেয়ে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সরব হওয়ার জন্য দলের সংসদীয় দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা।
তৃণমূলের ‘আপত্তি’ নিয়ে কটাক্ষ করে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “তৃণমূল এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সামগ্রিক সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া কোনও এক জন মন্ত্রী, বিশেষ করে শরিক দলের মন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।”
খুচরো ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত শিল্প মহল অবশ্য কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে খোলা গলায় স্বাগত জানিয়েছে। আরপিজি গোষ্ঠীর কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েন্কা বলেন, “কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ স্বাগত। এর ফলে প্রমাণ হল, কেন্দ্র আবার আর্থিক সংস্কারের পথেই হাঁটছে।” ফিউচার গোষ্ঠীর কর্ণধার কিশোর বিয়ানি বলেন, “দেশের খুচরো বিপণন শিল্পের কাছে এটি একটি বড় সুযোগ। আমার ধারণা খুচরো ব্যবসায়ীরা যেমন এর সুবিধা নিতে পারবেন, তেমন ক্রেতারাও এর সুফল পাবেন।”
এই সিদ্ধান্তের ফলে কৃষক এবং খুচরো ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এই অভিযোগ উড়িয়ে বণিকসভা সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় সাধারণ ক্রেতা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ছাড়াও ছোট চাষিরা উপকৃত হবেন। কৃষকরা সরাসরি সংস্থাগুলিকে পণ্য বিক্রির সুযোগ পাবেন। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে তাঁদের আয়ও নিশ্চিত করতে পারবেন কৃষকরা।” পাশাপাশি, বাজারে জোগান বাড়লে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে বলে বণিকসভাটির মত।
একই যুক্তি দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারও। তাদের বক্তব্য, এর ফলে এক দিকে ভারতে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তেমনই মূল্যবৃদ্ধি কমবে। কৃষকরাও ফসলের জন্য ভাল দাম পাবেন। চাষের মাঠ থেকে ক্রেতাদের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরবরাহ ব্যবস্থায় যে সব দুর্বলতা রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে। সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটি ও হিমঘরের অভাবে বহু ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বিদেশি লগ্নি এলে হিমঘর তৈরি হবে, প্রযুক্তি, ভাল ব্যবস্থাপনা, পেশাদারিত্ব আসবে।
অন্য দিকে বিরোধীদের বক্তব্য, প্রথমে বহুজাতিক সংস্থাগুলি কম দামে পণ্য বেচলেও এক বার বাজারে জাঁকিয়ে বসার পর দাম বাড়াবে। ন্যায্য মূল্য পাবেন না কৃষকরা। পাড়ার মুদি দোকানগুলিও মার খাবে। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি আজ বলেন, “সরকার হিমঘর ও সরবরাহ ব্যবস্থা মজুত করবে বলছে ঠিকই। কিন্তু ছোট শহরে সড়ক ও বিদ্যুৎ পরিকাঠামো সরকার এখনও তৈরি হয়নি।” বিজেপি অন্য ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধী নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতার কারণ হল, ছোট দোকানের মালিক ও ছোট ব্যবসায়ীরা বিজেপি-র বড় ভোটব্যাঙ্ক। বিরোধীদের আরও যুক্তি, খুচরো ব্যবসা হল কৃষির পরে সব থেকে বড় কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্র। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি এলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে না।
ঘটনা হল, অতীতে কংগ্রেসও বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু আজ কংগ্রেসের তরফে বলা হয়েছে, আর্থিক কারণেই বেশি দিন এই সিদ্ধান্ত থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া, চিন ও মালয়েশিয়ায় এই অনুমোদন দেওয়া হলেও, কোনও অসুবিধা হয়নি।
কেন্দ্রের তরফে বলা হয়েছে, ক্রেতা বা কৃষকরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার জন্য একগুচ্ছ শর্ত আরোপ করা হচ্ছে।
যেমন,
যে সব শহরের জনসংখ্যা ১০ লক্ষের বেশি, সেখানেই এই ধরনের বিক্রয়কেন্দ্র খোলা যাবে।
কৃষিজ পণ্য কেনার প্রথম অধিকার থাকবে সরকারেরই।
বেসরকারি সংস্থাকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের থেকে অন্তত ৩০ শতাংশ পণ্য কিনতে হবে। এক ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রেও একই শর্ত রাখা হয়েছে।
ন্যূনতম বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ হতে হবে অন্তত ১০ কোটি ডলার।
বিদেশি বিনিয়োগের অন্তত অর্ধেক লগ্নি করতে হবে প্রক্রিয়াকরণ, গবেষণা, মান নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ কেন্দ্র, হিমঘরের মতো পরিষেবায়।
টাটকা কৃষিজ পণ্য, ফল, শাকসব্জি, ফুল, শস্য, ডাল, ডিম, মাছ, মাংসের মতো পণ্য বিক্রি করা যাবে। কিন্তু কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, বস্ত্র ক্ষেত্রে এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, খুচরো ব্যবসায় লগ্নির ক্ষেত্রে ভারত অন্যতম সম্ভাবনাময় বাজার। বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্তের এই লোভনীয় বাজারের মাত্র ৬% রয়েছে সংগঠিত খুচরোর ব্যবসার দখলে। ফলে বাজার হিসেবে সব খুচরো ব্যবসায়ী বহুজাতিকের পছন্দের তালিকার একেবারে উপরের দিকে রয়েছে ভারত।
ভারতে পাইকারি ব্যবসায় আগেই পা রেখেছে জার্মান বহুজাতিক মেট্রো। পাইকারি ব্যবসায় এসেছে বিশ্বের বৃহত্তম রিটেল বহুজাতিক ওয়াল-মার্টও। ভবিষ্যতে খুচরো ব্যবসায় ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা খোলা রাখতে সুনীল মিত্তলের ভারতী গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে তারা। ফরাসি রিটেল বহুজাতিক ক্যারফোর একই কৌশলে এ দেশে পাইকারি ব্যবসায় লগ্নি করেছে। এ বার বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি মেলায় ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এ দেশের বাজারে তাদের ঢুকে পড়া সহজ হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.