পঞ্চবাণের ধুন্ধুমার যুদ্ধ আসলে স্বদেশি বনাম বিদেশি
কাল পৌনে আটটা থেকেই লোকে ঠায় দাঁড়িয়ে। ক্লাস এইটের ছাত্র থেকে মাঝবয়সি মহিলা স্মৃতি রায়। গানের সুরে ছড়া কাটা হচ্ছিল মোহনবাগান মাঠের প্রধান গেটে।
আমাদের স্পিরিট, জয়ের আমেজ
হোসে ব্যারেটো রামিরেজ।

দেখে আইপ্যাড নিয়ে ছবি তুলতে লেগে গেলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ফুটবলার কার্লটন পামের।
সল্টলেক স্টেডিয়ামে ইস্টবেঙ্গল প্র্যাক্টিসে কিশোর, তরুণদের ভিড়টা একটা সময় গোললাইন অবধি উঠে এল। কর্নার স্পট থেকে গোললাইন গিজগিজে মুখ। উগা ওপারার জন্য উত্তেজিত চিৎকার উঠছিল, “ওপারা আপ, ওডাফা ডাউন।”
কলকাতার রাস্তায় টহল দিলে আবার ইতিউতি উঁকি মারছে মেরুন -সবুজ, হলুদ -লাল পতাকা। অনেক দেওয়ালে ওই চারটি রং। ফেসবুক ওয়াল ফের ছেয়ে গিয়েছে ছড়া, টিকা -টিপ্পনী, রসিকতা, গালাগালে। টিকিটের চাহিদা ইডেন টেস্টের থেকে দশ গুণ বেশি।
এক সপ্তাহ আগের রবিবার বাঙালির খেলার ভগবান ছিলেন সচিন -রাহুল -ধোনি। এই রবিবার অন্য ভগবান। ব্যারেটো -ওডাফা -ড্যানিয়েল। কিংবা পেন -ওপারা -গাও। এবং এই মোহনবাগান -ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের ভাগ্য শুধু এঁদের উপরই নির্ভর করছে না। আরও মুখ আছে।গরিব ছেলেটিকে প্রোটিন খেতে হবে বলে প্রতিদিন দশ টাকা দিতেন কোচ। বরাদ্দ একটা ডিম, একটা রসগোল্লা, সঙ্গে চাউমিন। রিষড়া স্পোর্টিং থেকে ডিফেন্ডার কিংশুক দেবনাথ তখন এরিয়ানে। কোচ রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়।
ম্যাঞ্চেস্টার সিটির প্রাক্তন গোলকিপার জন বুরিজ মোহনবাগান মাঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, “কিমসুম ছেলেটা কে? নামটা ঠিক উচ্চারণ করলাম তো?” তিনি আসলে খোঁজ করছিলেন কিংশুকেরই।
বাংলা -সিকিম সীমান্তের ছোট্ট নির্জন গ্রাম মল্লিবাজার। সেখানকার এক শান্ত সিকিমিজ তরুণ সল্টলেক স্টেডিয়াম থেকে বেরোনোর সময় নাম করছিলেন প্রয়াত পেম দোরজির। দোরজিকে কোনও দিন দেখেননি। তবে ভারতীয় ডিফেন্ডার শুনলেই তাঁর মনে পড়ত দোরজির কথা। তাঁর প্রিয় স্টপার এমনিতে রিও ফার্দিনান্দ। কিংশুক দেবনাথ এবং নির্মল ছেত্রী।
প্রার্থনা শপথ
নমাজ পড়ছেন মোহনবাগানের
নবি। ছবি-শঙ্কর নাগ দাস
সতীর্থদের তাতাচ্ছেন ইস্টবেঙ্গলের
ওপারা। ছবি-উৎপল সরকার
বাঙালির চিরন্তনী যুদ্ধের স্কোরলাইন এই দু’জনের উপর নির্ভর করছে লিখলে ভুল হবে? এঁরাই দু’দলের সেরা ধারাবাহিক ডিফেন্ডার।
দুই দলের রক্ষণ দারুণ জমাট নয়। গোলকিপাররাও ভরসা জাগাতে ব্যর্থ। এই অবস্থায় দু’বছর আগের গোলের ম্যাচ দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। ওডাফা -ব্যারেটোকে আটকানোর ক্ষেত্রে ওপারাকে কতটা সাহায্য করতে পারবেন ভাইচুংয়ের ভক্ত নির্মল? গাও -পেনকে আটকাতে অ্যাস্ট্রোটার্ফে অনভ্যস্ত ড্যানিয়েলকে কতটা ভরসা দিতে পারবেন শিশির ঘোষের পাড়ার ছেলে কিংশুক? প্রশ্ন দুটোর উপরই বড় ম্যাচের ফল দাঁড়িয়ে।মোহন -ইস্ট ম্যাচের স্মৃতির পাতা উল্টে গেলে অনেক হারিয়ে যাওয়া তারারা ফুটে ওঠে। নাজিমুল হক, ফাল্গুনী দত্ত, দীপঙ্কর রায়, অমিত দাস, সরোজ দাস, মনোহরণ, শুভাশিস রায়চৌধুরী। আর একটু পিছিয়ে গেলে শুভঙ্কর সান্যাল, কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী, তপন দাস, সি ডি ফ্রান্সিস, সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিত কর্মকার। এমন অনেক অনামী মুখই গোল করে হঠাৎ নায়ক হয়ে উঠেছেন এই ম্যাচে।
চোদ্দো বছর আগে লক্ষ ৩১ হাজার দর্শকের বড় ম্যাচে গোল করা নাজিমুল এখনও বেকার। এখন বসিরহাটের বিবিপুর গ্রামে। খুব কষ্টে আছেন। বার মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের ক্লাব কালীঘাট মিলন সঙ্ঘে ট্রায়াল দিতে এসেও সুযোগ পাননি। বিস্মৃত নায়ক নাজিমুল বলছিলেন, “টিভিতেই দেখব খেলা। এখনও নিয়মিত খেলি। কলকাতায় সবাই আমায় ভুলে গেল। কী করা যাবে?”
হয়তো আড়ালে থাকা এমনই কোনও মুখ আলোয় উঠে এল রবি -সন্ধেয়। হয়তো এল না। ফিরে এল সেই পরিচিত বিদেশি মুখগুলো।
আড়াই বছর আগের এক ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের - জয়ে গোল ছিল রহিম নবি ( ) , সুনীল ছেত্রীর। পাঁচ বছর আগে ইস্টবেঙ্গলের - জয়ে গোল করেছিলেন গৌরাঙ্গ দত্ত। ওই তিন জনেই বার মোহনবাগানে। গত দু’বছরে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে বড় ম্যাচে গোল করা দুই পঞ্জাবি সিংহ বলজিৎ রবিন বারও লাল -হলুদ জার্সিতে। মোহন -ইস্ট ম্যাচকে ভারতীয় বনাম বিদেশি যুদ্ধ ধরলে ভারতীয় বার এঁরাই।
মোহনবাগানের ম্যাসকট ‘বাঘ’ হওয়ায় ইস্টবেঙ্গলের এক ফ্যান ক্লাব ‘রিয়াল পাওয়ার’ টুইটারে অবিরাম প্রচার চালাচ্ছে, ইস্টবেঙ্গলের ম্যাসকট সিংহ। পশুদের রাজা। কাকতালীয় হল, দলটার গোলকিপারও সিংহ (গুরপ্রীত ) , ফরোয়ার্ডও সিংহ (রবিন, বলজিৎ ) ইস্টবেঙ্গল প্র্যাক্টিসের পরেও উত্তরপ্রদেশের নম্বর লাগানো গাড়ি করে বেরিয়ে গেলেন দুই সিংহ। গোলকিপারকে পাশে বসিয়ে স্টিয়ারিংয়ে ফরোয়ার্ড রবিন। দ্রুত বেরোনোর সময় অন্য এক সতীর্থের গাড়িতে ঘষটে গেল। ম্যাচে নিশ্চয়ই অনেক মসৃণ টেক -অফ হবে। যুবভারতী মাঝে মোহনভারতী হয়েছিল। ইদানীং আবার ইস্টভারতী।
মোহনবাগান টিম প্র্যাক্টিসে নামার সময় সবার আগে ওডাফা। মাঝখানে সুব্রত -প্রশান্ত। তাঁদের পিছনে ব্যারেটো। একেবারে সবার শেষে দুই ভারত অধিনায়ক রহিম নবি, সুনীল ছেত্রী। মোহনবাগান টিডি তাঁর দলটাকেও এমন পরিকল্পনা নিয়ে সাজানোর চেষ্টায়। টোলগে -মেহতাব না থাকলেও মর্গ্যানের দল পাঁচটি ব্যাপারে সুব্রতর থেকে এগিয়ে। গতি, দৌড়, সেট পিস, রক্ষণ এবং গেম মেকিং। সুব্রতর পাল্টা পঞ্চবাণ কী? ফরোয়ার্ড লাইন, অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত দক্ষতা, টিমস্পিরিট, নবির মতো ইউটিলিটি ফুটবলার।

আজ ২৯৯
সব মিলিয়ে ইস্ট-মোহন আই লিগে
২৯৮ মোট ম্যাচ ২৮
১১২ ইস্টবেঙ্গলের জয় ১২
৮৩ মোহনবাগানের জয়
১০৩ ড্র
২৭২ ইস্টবেঙ্গলের গোল ৩৩
২২৩ মোহনবাগানের গোল ২৬

লন্ডনের ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ কাগজে সপ্তাহ তিনেক আগে ইস্টবেঙ্গল কোচ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কাছে আমি আই লিগে কোন জায়গায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি মোহনবাগানকে মরসুমে তিন বার হারাতে পারি।” মোহনবাগানের বিরুদ্ধে টানা পাঁচ ম্যাচে অপরাজিত ট্রেভর মর্গ্যান। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশ ম্যাচের রেকর্ডের পরেই তিনি। বুঝে গিয়েছেন, এখানে আসল ম্যাচ কোনটা।
দুই নতুন অতিথি ওডাফা এবং ড্যানিয়েলকে এই কথাটাই বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ব্যারেটো। এটাই আসল ম্যাচ। ওডাফাই বোধহয় জীবনের প্রথম ডার্বিতে সবচেয়ে বড় চাপে। তাঁর ফিটনেস জল্পনার বিষয়। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী, ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির নিয়মিত দর্শক ব্রাত্য বসু এক টিভি অনুষ্ঠানে রসিকতা করেছেন, “ওডাফা এখন খেললেই আমাদের সুবিধে। দাঁড়িয়ে থাকবে। বাঞ্ছারামের মতো।” মোহনবাগানেও ‘বাঞ্ছারাম’ নিয়ে জোর আলোচনা।
তপসিয়ার গলির তস্য গলিতে একদা একঝাঁক স্বদেশির সঙ্গে থাকতেন ওডাফা। মেসবাড়ি বানিয়ে। একশো -দেড়শো টাকায় খেপ খেলে বেড়াতেন শহরতলির নানা জায়গায়। পয়সা জুটত না এক -এক দিন। খাওয়া হত না। এখন দু’কোটি টাকার তিনি থাকেন সাউথ সিটির তিন নম্বর টাওয়ারে। ব্যারেটো চার তলায়, ওডাফা তেত্রিশ তলায়। ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়ালে দেখা যায় প্রায় পুরো কলকাতাই। যেন হাতের মুঠোয়। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে, ওখানে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই ওডাফা -ব্যারেটোর মনে হবে, কলকাতাটা কি সত্যি সত্যিই হাতের মুঠোয় আসবে? গড়িয়ায় পেন ওর্জি, রাজারহাটে অ্যালান গাও। রিষড়ায় কিংশুক, সল্টলেকে নির্মল। নিশ্চিত, সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সবার এমনই কিছু মনে হবে।
আজ যুদ্ধের সেনারা

ইস্টবেঙ্গলের সম্ভাব্য দল: গুরপ্রীত, নওবা, ওপারা, নির্মল, রবার্ট, সঞ্জু, পেন, সুশান্ত, ভাসুম, রবিন, গাও।
মেহতাব, টোলগে, পাইতে।

মোহনবাগানের সম্ভাব্য দল :সংগ্রাম, সুরকুমার, ড্যানিয়েল, কিংশুক, ধনরাজন, জুয়েল, ব্যারেটো, রাকেশ, নবি, সুনীল, ওডাফা।
হাদসন, আনোয়ার।

রবিবার
আই লিগ ফুটবলে

মোহনবাগান : ইস্টবেঙ্গল (যুবভারতী, ৬ -৩০ )
চার্চিল : মুম্বই এফ সি (মারগাও )
হ্যাল : এয়ার ইন্ডিয়া (বেঙ্গালুরু )




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.