মাত্র চার দিনের মধ্যে ফের চাষির আত্মহত্যার ঘটনায় ধান বিক্রি করতে না পারার অভিযোগ উঠল রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বলে পরিচিত বর্ধমানে।
বর্ধমান শহরের কাছেই চান্ডুল গ্রামে মঙ্গলবার রাতে গাছ থেকে দড়ির ফাঁসে ঝুলতে দেখা গিয়েছিল ভবানী পোড়েল নামে এক চাষির দেহ। শুক্রবার রাতে ভাতারের কালিটিকুরি গ্রাম থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সফর মোল্লা (১৮) নামে এক তরুণকে। সেখানেই রাত ১০টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান।
ভবানীবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবারের লোকজন অভিযোগ তুলেছিলেন, মহাজনি ঋণ নিয়ে চাষ করা ধান বিক্রি করতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। শনিবার সফরের পরিবারের তরফেও অভিযোগ করা হয়, বাড়িতে গোলায় মজুত ১৮০ বস্তা ধান বিক্রি করতে না পেরে তিনি এমনিতেই হতাশায় ভুগছিলেন। তার উপরে রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সাত বিঘে জমিতে চাষ করা খরিফ ধান।
মৃতের মা রিজিয়া বিবি জানান, রাতে তাঁর সঙ্গে বসে টিভি দেখতে দেখতে আচমকা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সফর। কিছু ক্ষণ পরেই তাঁর মুখ দিয়ে লালা ঝরতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। তিনি গ্রামের লোকেদের ডাকেন। তাঁরাই সফরকে হাসপাতালে ভর্তি করান। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য ধান বিক্রি করতে না পারায় চাষির আত্মহত্যার কথা মানতে চাননি। তিনি বলেন, “ভাতারেই দু’টি কেন্দ্রে সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা হচ্ছে। ধান বিক্রি করতে না পরে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, এ কথা অমূলক। আমি যা শুনেছি, ছেলেটি মদ খেয়েছিল। মায়ের সঙ্গে ঝামেলা বাধে। তারই জেরে এই আত্মহত্যা।” |
এ দিন কালিটিকুরির অনেকেই অবশ্য ধান বিক্রি করতে না পারার অভিযোগ জানান। সফরের খুড়তুতো দাদা জিয়াবুল মোল্লার খেদ, “আমাদের ঘরেও প্রায় ১০০ বস্তা বোরো ধান জমে রয়েছে। কিছুতেই বিক্রি হচ্ছে না। বাড়ির মহিলাদের গয়না বিক্রি করে সংসার চালাতে হচ্ছে। এ নিয়ে নিত্য অশান্তি চলছে।” তাঁর অভিযোগ, ৫০ কেজি-র বস্তার সরকারি সহায়ক মূল্য যেখানে ৬৪৮ টাকা, সেখানে ৪০০-৪৫০ টাকায় তা কিনতে আসছেন ব্যবসায়ীরা। তাতে চাষের খরচটুকুও উঠবে না। সফরের আত্মীয় শেখ নুরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের গোলাতেও প্রায় ৩০০ বস্তা ধান পড়ে আছে। দাম বাড়ছে না। কোথায় সরকারি ভাবে ধান কেনা হচ্ছে , তার খবরও পাচ্ছি না। তার উপরে নানা নিয়মের বেড়াজালে সরকারকে ধান বিক্রি করতেও অনেকের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে।”
গ্রামের বাসিন্দা রফিক আহমেদরা বলেন, “মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিয়েই চাষ করতে হয় ছোট চাষিদের। ঘটিবাটি বেচে আমাদের তা শোধ করতে হবে।” শেখ মিরাজ হাসান, আলারুল হকের দাবি, “গ্রামে অন্তত ৪০-৫০ জনের বাড়িতে প্রচুর বোরো ধান জমে রয়েছে।” তাঁদের অভিযোগ, মজুত ধান বিক্রি না হওয়ায় দিনে ২০০ টাকা মজুরি দিয়ে খেতে পাকা খরিফ ধান কাটানোর টাকাও তাঁদের হাতে নেই। স্থানীয় নিত্যানন্দপুর পঞ্চায়েতের গ্রামসভার তৃণমূল সদস্য শেখ নুরুল ইসলামের আক্ষেপ, “ভাতারেরই একটি চালকলে এসে খাদ্যমন্ত্রী সহায়ক মূল্যে ধান কেনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু পরে সেই চালকল বা বিডিও অফিসে গিয়েও চাষিরা ধান বিক্রি করতে পারেননি। সকলেই বলেছে, আপাতত হাতে টাকা নেই, পরে আসুন।”
বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা অবশ্য দাবি করেন, “সফরের বাড়িতে যে ধান মজুত রয়েছে, তা আসলে ওঁর দিদির জমির ধান।” কিন্তু দিদির জমির ধানই বা কেন বিক্রি হয়নি, তার সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তৃণমূল নেতা নুরুল ইসলাম পাল্টা বলেন, “সফরেরা দুই ভাই। জেলাশাসক ওঁদের দিদিকে কোত্থেকে আবিষ্কার করলেন?” চান্ডুল গ্রামে চাষির মৃত্যু প্রসঙ্গে জেলাশাসকের দাবি, “বাড়িতে কোনও ধানই মজুত ছিল না বলে ভবানী পোড়েলের আত্মীয়েরা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন।” খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “ভবানী হিমঘরে আলু রেখেছিলেন। তার দাম পড়ে যাওয়াতেই আত্মহত্যা করেছেন বলে জেলা থেকে রিপোর্ট পেয়েছি।” |