মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, ‘হবে।’
স্বাস্থ্য দফতর জানিয়ে দিল, ‘হবে না।’
স্বাস্থ্য দফতরের বক্তব্য: রোগী রেফারের প্রবণতা রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ‘রেফারেল রেজিস্টার’ চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন, বাস্তবে সেটা অসম্ভব। স্বাস্থ্য-কর্তাদের স্বীকারোক্তি, “এই মুহূর্তে রাজ্যে স্বাস্থ্যের যা পরিকাঠামো, তাতে রেফারেল রেজিস্টার কার্যকর করা বাস্তবসম্মত নয়।”
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরেই টাউন হলে আয়োজিত চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, মফস্সল থেকে কলকাতায় অহেতুক রোগী রেফার ঠেকাতে জেলাস্তরে সরকারি হাসপাতালে ‘রেফারেল রেজিস্টার’ চালু হবে। ওই খাতায় লিখতে হবে, কেন রোগীকে অন্যত্র পাঠাতে হচ্ছে। পনেরো দিন অন্তর স্বাস্থ্য-কর্তারা রেজিস্টারটি যাচাই করবেন। ফলে বিনা কারণে কাউকে কলকাতায় রেফার করলে তা ধরা পড়ে যাবে। দোষী চিকিৎসককে শাস্তি দেওয়া হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে রেফারেল রেজিস্টার তৈরির কাজ শুরুও হয়েছিল। কিন্তু তা চালু হওয়ার আগেই ‘রণে ভঙ্গ’ দিয়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। ব্যাখ্যা হিসেবে যাঁরা এখন বলছেন, “গত ছ’মাসে জেলা হাসপাতালে পরিকাঠামোর একটুও উন্নতি হয়নি। ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা-কর্মীর সংখ্যা বাড়েনি। সব রোগীকে যথাযথ পরিষেবা দেওয়া অসম্ভব।”
সুতরাং রেফার বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। কিন্তু রেফার চলাটাই যদি রেওয়াজ হয়, তা হলে তা আটকানোর জন্য ‘রেজিস্টার’ চালু করে লাভ কী? মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা কি স্রেফ ‘কথার কথা’ হয়ে থাকবে? |
নথি-কথা
|
রেফারেল রেজিস্টার কী |
কী লেখা হবে |
• রোগীকে অন্যত্র
পাঠাতে হলে সব তথ্য
লিখে রাখার খাতা |
• রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স, রোগের ধরন,
রেফারের কারণ, কোথায় রেফার।
• রেফারেল হাসপাতালের
রেজিস্টারেও
চাই একই তথ্য। |
তৈরি হওয়ার কথা |
• রেফারেল কার্ড যাতে রেফারড রোগীর শারীরিক অবস্থার বিবরণ থাকবে।
• কোনও পরীক্ষা হলে থাকবে তারও উল্লেখ। |
|
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর, “এত কম ডাক্তার, নার্স নিয়ে রেফারেল রেজিস্টারের মতো অডিট প্রক্রিয়া চালাতে চাওয়াটা যথেষ্ট ঝুঁকির। এটাই আমাদের সৎ স্বীকারোক্তি।” স্বাস্থ্য-কর্তারা কবুল করছেন, লোকাভাবে এ পর্যন্ত কোনও হাসপাতালে গিয়ে রেফারেল রেজিস্টার যাচাই করা হয়নি। কোথায় রেজিস্টার রাখা হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে না, সে সম্পর্কে খোঁজ-খবরও নেওয়া হচ্ছে না। এই অবস্থা কেন?
স্বাস্থ্য দফতরের হাসপাতাল সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্বরঞ্জন শতপথীর মতে, রেফারেল রেজিস্টার বা রেফারেল কার্ডের পরিকল্পনাতেই প্রাথমিক গলদ থেকে গিয়েছে।
তাঁর যুক্তি: শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী রেফারের ক্ষেত্রেই রেফারেল রেজিস্টার ব্যবহারের ব্যবস্থা রয়েছে। আদতে অধিকাংশ রোগী ইমার্জেন্সি থেকেই অন্যত্র রেফারড হয়ে যান। অথচ সেই হিসেব রাখার কোনও খাতা নেই!
রেফারেল রেজিস্টারের হাল কী, কিছু মহকুমা হাসপাতালে খোঁজ নিয়েই তার একটা আঁচ মিলেছে। কী রকম? যেমন, পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতাল। সেখানে এখনও রেজিস্টার চালু হয়নি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালে অবশ্য মাস দু’য়েক হল রেজিস্টার রাখা হচ্ছে, তবে নাম-কা-ওয়াস্তে। সেখানকার কর্তারা জানাচ্ছেন, গাইনি ও সার্জন এত কম যে, ওই দুই বিভাগের অধিকাংশ রোগীকে অন্যত্র পাঠানো ছাড়া উপায় থাকে না। কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের সুপার জানাচ্ছেন, তাঁদের রেফারেল রেজিস্টার যেমন চালু আছে, তেমন রোগী রেফারও চলছে। কারণ হিসেবে লেখা হচ্ছে, ‘পরিকাঠামোর অভাব।’ করিমপুর-ঘাটাল-খড়্গপুরের মতো অনেক হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা রেজিস্টার রাখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য-কর্তারা কখনওই পরীক্ষা করতে আসেন না-দেখে আর গা করেননি।
কেন যান না কর্তারা? রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা শ্যামাপদ বসাকের জবাব, “জেলাস্তরের হাসপাতালে সার্জন, অর্থোপেডিক সার্জন, ল্যাবরেটরি পরিষেবার অভাব রয়েছে। তাই রোগীর অবস্থা একটু জটিল হলে রেফার করতেই হবে। এই অবস্থায় রেজিস্টার যাচাই করে কী লাভ?”
|