মিছিলে ক্ষুব্ধ, সতর্ক করলেন কংগ্রেসকে
রাজ্যে কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গে জোটে থাকতে চায় কি না, তা কংগ্রেসকেই ঠিক করতে হবে বলে ‘হুঁশিয়ারি’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার তিনি স্পষ্টই বলেন, “ওদের (কংগ্রেস) সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন দিকে থাকবে। ওদেরই ঠিক করতে হবে, ওরা সিপিএমের সঙ্গে থাকবে না তৃণমূলের সঙ্গে থাকবে। এখানে। দিল্লিতেও। যারা সিপিএমের সঙ্গে থাকে, তৃণমূল তাদের সঙ্গে ঘর করে না!”
আগামী সপ্তাহেই দিল্লি যাওয়ার কথা মমতার। তিনি কি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে রাজ্য কংগ্রেস সম্পর্কে অভিযোগ জানাবেন? মমতার জবাব, “আমি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না! ওরা গালাগালি করছে। কিন্তু আমরা সৌজন্য দেখাচ্ছি। আমি তো জোটের শর্ত ভাঙিনি।”
বিধানসভা ভোটের পর মিলেমিশেই সরকার গড়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূল। যদিও সরকার গঠনের জন্য মমতার কংগ্রেসকে দরকার ছিল না। কিন্তু দু’দল জোট বেঁধে ভোট লড়ায় তিনি একক সরকার গঠনের পথে যাননি। তবে ভোটের পর ছ’মাস কাটতে না-কাটতেই বিভিন্ন ঘটনায় দু’পক্ষের সম্পর্ক ‘তিক্ত’ হচ্ছিল। তা তুঙ্গে ওঠে গত ৪৮ ঘণ্টায়। যখন প্রকাশ্যেই মমতার পঞ্চায়েত-মডেলের বিরোধিতা করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তা আরও বেড়ে যায় শুক্রবার কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূর তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসের’ প্রতিবাদে হাজরা থেকে ময়দানে গাঁধীমূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত মিছিল করায়। মৌসমের সঙ্গেই মিছিলে ছিলেন প্রদীপবাবুও। ছিলেন রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সি। এমনিতেই যাঁর সঙ্গে মমতার সম্পর্ক যথেষ্ট ‘মধুর’। তা ‘মধুরতর’ হয়েছে সম্প্রতি রায়গঞ্জে এইম্স ধাঁচের হাসপাতাল গঠন নিয়ে টানাপোড়েনে।
সন্ত্রাস-বিরোধী মিছিলে কংগ্রেস সাংসদ মৌসম নুর। ছবি: সুদীপ আচার্য
দুপুরে মৌসমের ওই মিছিলের পরেই সন্ধ্যায় ‘কড়া প্রতিক্রিয়া’ দেন মমতা। এমনও বলেন যে, “সামনে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার উপ-নির্বাচন। এই সময়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিছিল করে ওরা কি সিপিএমকে সাহায্য করতে চাইছে?”
বস্তুত, মমতা তাঁর ‘উষ্মা’র কথা জানাতে এ দিন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। প্রণববাবুকে তিনি ফোনে পাননি। কিন্তু তাঁর ‘ক্ষোভের’ কথা পৌঁছে দেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলের কাছে। তার পরেই রাতে প্রদীপবাবুকে ফোন করেন প্রণববাবু। কেন ওই মিছিল হয়েছে, প্রণববাবু তা জানতে চেয়েছিলেন বলে প্রদেশ সভাপতি জানিয়েছেন। ঘটনাচক্রে, আগামিকাল, রবিবার নেতাজি ইন্ডোরে প্রদেশ কংগ্রেসের পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলন। সেখানে মুখ্য বক্তা প্রণববাবুই। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ইন্ডোরে এই বিষয়ে কিছু বলেন কিনা, তার দিকে তাকিয়ে থাকবে অবশ্যই শাসক জোট।
মমতার ‘বার্তা’ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে প্রদীপবাবু বলেছেন, “আমরা নির্বাচনে লড়েছি জোট করেই। এবং আমরা জোটে আছি। আমাদের দলের শাখা সংগঠন মিছিল করেছে মানেই আমরা জোট ভেঙে দিচ্ছি, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।” ওই মিছিল ‘পূর্বনির্ধারিত’ ছিল বলে প্রদীপবাবু জানিয়েছেন। একই কথা তিনি প্রণববাবুকেও জানিয়েছে বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর।
মৌসমের মিছিলের দিনই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে উত্তরবঙ্গের মালদহের গাজল এবং উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারে যান তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়। মৌসম যেমন মালদহ জেলার সাংসদ, তেমনই দীপা উত্তর দিনাজপুরের। কংগ্রেসের হাতে তৃণমূলের কর্মী খুনের প্রতিবাদেই সেখানে গিয়েছিলেন মুকুলবাবু। মালদহে তিনি যেমন বলেছেন, “আগামী পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল নিজেদের মালদহের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। তৃণমূলের শক্তিবৃদ্ধিতে কেউ কেউ ঈর্ষাণ্বিত হচ্ছেন। ভাবছেন, তাঁদের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে।” প্রসঙ্গত, মালদহ জেলা বরাবর ‘কংগ্রেসের ঘাঁটি’ বলেই পরিচিত। ইটাহারে গিয়ে মুকুলবাবু বলেন, “সংসদে জমি অধিগ্রহণ আইন পাশ হলেই রায়গঞ্জে হাসপাতালের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে রাজ্য চিন্তাভাবনা করবে। জোট শরিক কংগ্রেস সেটা বুঝেও স্রেফ রাজনীতির জন্য রাস্তায় নেমেছে!”
বেশ কিছু দিন ধরেই রায়গঞ্জের হাসপাতাল, মমতার উপর হামলায় অভিযুক্ত মোক্তারকে কংগ্রেসে নেওয়া, আবার কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত রাম পেয়ারি রাম-খালেক মোল্লাকে তৃণমূলে নেওয়া, বগুলায় পুলিশের গুলিতে কংগ্রেসের মহিলাকর্মীর মৃত্যু নিয়ে দুই শরিকের টানাপোড়েন চলছে। তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, এ সব সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর জেলাসফরে নিয়ম করে কংগ্রেসের মন্ত্রীদের নিয়ে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সে ভাবে কোনও আক্রমণ করা হয়নি। তবে মুকুলবাবু তাঁদের ‘ক্ষোভ’ জানিয়ে সম্প্রতি কংগ্রেসকে চিঠি দিয়েছেন। কংগ্রেস যার ‘কড়া’ জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নেও দুই শরিকের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছিলেন মমতা। তবে তিনি ‘প্রশমিত’ হন পেট্রোলের দাম কিছুটা কমে যাওয়ায়। তার আগেও প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের সমর্থন না-তোলার অনুরোধ জানান। সে দিক দিয়ে মমতার অবস্থান যথেষ্ট পোক্ত বলেই তৃণমূল শিবিরের দাবি। তাদের আরও বক্তব্য, কেন্দ্রে সরকার চালাতে গেলে কংগ্রেসের তাঁদের দরকার। তা সত্ত্বেও রাজ্য শাখাকে হাইকম্যান্ড ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে পারছে না! মমতা-ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা মনে করেন, রাজ্য কংগ্রেস যে ভাবে নিয়মিত তৃণমূলকে ‘আক্রমণ’ করছে, তাতে শীর্ষনেতৃত্বেরও একাংশের ‘অনুমোদন’ রয়েছে। যে কারণে এ দিনও মমতা বলেছেন, “রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জিতে সরকার করেছি। কারও উপর নির্ভরশীল নই। এ দিকে-ও দিকে রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। কংগ্রেস চাইলে নিজের মতো থাকুক। আমরা একলা চলতে পারব।” মুখ্যমন্ত্রী মমতার আরও বক্তব্য, “আমরা দুর্বল নই। রাজ্যের মানুষই শেষ কথা বলবে। ওদের বাদ দিয়েই মানুষ আমাদের ভোট দেবেন।”
মৌসম এ দিন সরাসরি অভিযোগ করেন, “তৃণমূলের কর্মীরা কংগ্রেস কর্মীদের উপর বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার, হামলা করছে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে কংগ্রেস কর্মীদের। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টে তৃণমূলের পক্ষ নিয়ে পুলিশ কংগ্রেসিদেরই হেনস্থা করছে।” মৌসম আরও জানান, এ বিষয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে চান। মৌসম বলেন, “জোটে রয়েছি। কংগ্রেস কর্মীদের নিরাপত্তা এবং তাঁদের সম্মান করাটাও মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। এখনও পর্যন্ত রাজ্যের যেখানে যেখানে কংগ্রেসের উপর তৃণমূল হামলা চালিয়েছে, তার তথ্যপ্রমাণ নিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। আশা করি, বিষয়টি উনি বিবেচনা করবেন।”
সরকার বা তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় না-বসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-হামলার অভিযোগ এনে যে ভাবে কংগ্রেস পথে নেমে ‘প্রতিবাদ’ করছে, তাতে তারা পরোক্ষে সিপিএমের ‘হাত শক্ত’ করছে বলে মন্তব্য করেন মমতা। রাজ্য কংগ্রেসকে মমতার হুঁশিয়ারি, “ওরা পথে নেমে মিছিল করলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও পাল্টা মিছিল করবে। দক্ষিণ কলকাতায় ভোটের আগে এই মিছিল করে ওরা কাকে সমর্থন করছে?” এক নিঃশ্বাসে মমতা বলেন, “ওরা তো বরাবরই সিপিএমকে মদত দিয়েছে। সিপিএমেরই হাত শক্তিশালী করছে।”
যে অভিযোগের জবাবে প্রদীপবাবু বলেন, “কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতৃত্ব সিপিএমের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এখনও আমরা সিপিএমকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে বা তাদের ফেরত আসার ব্যবস্থা করতে আমরা প্রস্তুত নই।” সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, “সিপিএমের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের হাতে কংগ্রেসের ১১ হাজার কর্মী খুন হয়েছেন। বাংলার রাজনীতিতে যে সিপিএম হিংসা নিয়ে এসেছিল, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করার প্রশ্ন উঠতে পারে না। দলগত ভাবে আমরা সিপিএমের বিরোধী ছিলাম, আছি এবং থাকব।”
এ দিনের মিছিল সম্পর্কে প্রদীপবাবু বলেন, “আমাদের ছেলেরা যখন আক্রান্ত হয়ে কথা বলে, তখন তারা জোট ভাঙার কথা বলে না। আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। যেখানে সংঘাত ও সংঘর্ষ হচ্ছে, সেগুলি বন্ধ করা প্রয়োজন। আমি নিজে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে হামলার ঘটনার অভিযোগ জানিয়েছি।” তাঁদের উপর সন্ত্রাসের ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন কি না, জানতে চাইলে প্রদীপবাবু বলেন, “নিশ্চয়ই বলব। তিনি তো আমাদের মুখ্যমন্ত্রী।’’ পথে নেমে শরিক দলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদ’ না-করে সরকার বা দলের সঙ্গে আলোচনার কথা শরিক দলকে বলেছেন মমতা। কিন্তু তাঁর কথা না শুনে কংগ্রেস নেতাদের একাংশ সভায়-মিছিলে প্রকাশ্যে তৃণমূল বিরোধিতা করায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী। এ দিনও তিনি কংগ্রেসকে সে কথা মনে করিয়ে দেন। কংগ্রেসের একাংশের অবশ্য এখনও আশা, জোট ভাঙবে না। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতাও এ দিন জানান, বাম-বিরোধী ভোট ভাগ না-হতে দেওয়ার তাগিদেই দু’দল পরস্পরের সঙ্গে থাকবে। তাঁর কথায়, “এক সঙ্গে থাকতে গেলে ঠোকাঠুকি তো লাগেই। তবে তা মিটেও যায়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.