মাওবাদীদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের শান্তি প্রক্রিয়া থেকে ‘অব্যাহতি’ চাইলেন সরকার-নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুধবার পাঠানো একটি চিঠিতে তাঁরা ওই বক্তব্য জানিয়েছেন। অন্যতম মধ্যস্থতাকারী সুজাত ভদ্রের কথায়, “নতুন পরিস্থিতিতে আমরা সদর্থক ভূমিকা নিতে পারছি না। তাই এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইছি।”
সুজাতবাবুদের এই চিঠির ফলে জঙ্গলমহলে শান্তিপ্রক্রিয়ার ‘আনুষ্ঠানিক’ সমাপ্তি ঘটল বলেই প্রশাসনের একাংশের ধারণা। আরও সহজ করে বললে, এর ফলে রাজ্য সরকারের সামনে মাওবাদী দমনে যৌথবাহিনীর অভিযান আরও জোরাল ভাবে শুরু করার ‘সুযোগ’ এসে গেল। তবে প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী এখনও যে কোনও তরফেরই প্রাণহানির বিরোধী। রাজ্য প্রশাসনকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, বন্দুকের লড়াই না-লড়ে অভিযান চালিয়ে জঙ্গলমহলকে যথাসম্ভব মাওবাদী-মুক্ত করা হোক। পাশাপাশি, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীদের মতো দলের নেতাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাওবাদীদের রাজনৈতিক ভাবে ‘বিচ্ছিন্ন’ করার। যে বার্তা তিনি পুরুলিয়ার বলরামপুরের সভায় দিয়ে এসেছিলেন।
বস্তুত, মমতা এখনও শান্তি-প্রক্রিয়া জারি রাখতেই আগ্রহী। এ দিন গাঁধীমূর্তির পাদদেশে পুরুলিয়ায় মাওবাদীদের হাতে নিহত দুই দলীয় কর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রক্তপাত চাই না বলেই শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। শান্তি প্রক্রিয়া শেষ হয় না। কোনও একটা ইজ্মের জন্য কিছু লোকের সমর্থন ও টাকায় কুখ্যাত অপরাধীরা মোচ্ছব করে বেড়াচ্ছে। তারা নাকি অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে লড়ছে! কিন্তু এই সরকার তো উন্নয়ন করছে। তা-ও কেন ওরা এখনও মানুষ মারছে?”
ক্ষুব্ধ মমতার বক্তব্য, “শিলদায় অত জন ইএফআর-কে ওরা মেরে ফেলল! পার্থ-সৌম্যজিতের মতো যারা পুলিশের কাজ করত, তাদেরও খুন করেছে। বাবু বসু, লালমোহন মাহাতো, জিতু সিংহ সর্দার, রাজেনের বাবা ও ভাইকেও খুন করল!”
মহাকরণ সূত্রের খবর, মাওবাদীদের নিরীহ মানুষ খুনের ঘটনায় ‘ক্ষুব্ধ’ হলেও মধ্যস্থতাকারীদের এখনই সরিয়ে দিয়ে কোনও ‘ভুল বার্তা’ দিতে নারাজ সরকার। সেটা ‘রাজনৈতিক ভাবে’ ঠিক হবে না। কিন্তু প্রশাসন প্রশাসনের কাজ করবে। পাশাপাশি মধ্যস্থতাকারীরাও কথা চালিয়ে যেতে পারেন। আগামী শনিবার মধ্যস্থতাকারীদের মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে ডেকেছেন বলেই সরকারি সূত্রে খবর। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “সুজাতবাবুরা চিঠিতে বলেছেন, তাঁদের আর প্রয়োজন আছে কি না, তা সাত দিনের মধ্যে তাঁদের জানানো হোক। মুখ্যমন্ত্রী সাত দিনের মধ্যে চিঠির জবাব না-দিলে তাঁরা ধরে নেবেন, তাঁদের আর প্রয়োজন নেই। মুখ্যমন্ত্রীর তরফে তাঁদের শনিবার কথা বলার জন্য ডাকা হয়েছে।”
রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এ দিন মুখ্যমন্ত্রী ‘প্রশাসনিক’ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। বৈঠকে জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, জঙ্গলমহলে উন্নয়ন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সক্রিয়তা’ প্রশংসনীয়। মুখ্যমন্ত্রী তখন জানান, তিনি কাউকে বন্দুক ধরতে বলেননি। মাওবাদীরা খুনের রাজনীতি করছে। জনগণও জনগণের মতো করে প্রতিরোধ করছে। প্রশাসনকেও তার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ প্রশাসন চুপ করে বসে থাকতে পারে না! মুখ্যমন্ত্রী সহকর্মীদের জানান, সরকার জঙ্গলমহলে সুশাসন চায়।
শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজ্য প্রশাসনও ‘আশাবাদী’। মাওবাদীরা ‘অপরাধমূলক কাজকর্ম’ ছাড়লে এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা বন্ধ করলে রাজ্য সরকার তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় আগ্রহী বলে এ দিন জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “হত্যা, তোলাবাজি, জঙ্গলের গাছ কাটার মতো অপরাধমূলক কাজকর্ম ছাড়তে হবে মাওবাদীদের। এই ধরনের কাজ চলতে থাকলে পুলিশ-প্রশাসন তা বন্ধ করতে দায়বদ্ধ। সাধারণ মানুষকে বিনা কারণে হেনস্থা করার অভিপ্রায় নেই পুলিশের।”
বলরামপুরের ঘটনার উল্লেখ করে ডিজি বলেন, “কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন এ ভাবে হত্যার পথে চলে গেলে তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ দায়বদ্ধ। তারা গুলি চালালে পুলিশকেও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে হবে। অপরাধমূলক কাজকর্ম বন্ধ করতেই পুলিশ সক্রিয় হচ্ছে।” এখনই যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করা হচ্ছে না বলে জানান ডিজি। বরং প্রয়োজনে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত বাহিনী চাওয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি। জঙ্গলে মাওবাদীদের মোকাবিলার পাশাপাশিই তাদের ‘কলকাতার মদতদাতাদের’ আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নাম না-করলেও তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক এবং কয়েকটি সংগঠনের কথা বলেছিলেন। এ দিনও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কিছু লোক কলকাতায় বসে মাওবাদীদের মদত দিচ্ছে। আমার আবেদন, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। মুখে কালো কাপড় বেঁধে হাতে বন্দুক নিয়ে যারা খুন করছে, তাদের বলব, নারকীয় ও জঘন্য খুনের রাজনীতি থেকে সরে আসুন। সরকার আপনাদের সকলের দায়িত্ব নেবে। প্রশাসন বা অন্য কেউই বন্দুক ধরবে না। বন্দুকের রাজনীতি বন্ধ হোক।”
ঘটনাচক্রে, ওই সংগঠনগুলি এ দিনই মমতার অভিযোগকে ‘কুরুচিকর’ বলে অভিহিত করে। সাংবাদিক বৈঠক করে অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সম্পাদক (এই সংগঠনের নাম করেন মমতা) রক্তিম ঘোষ বলেন, “নির্দিষ্ট ভাবে কিছু গণসংগঠন ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের নামে মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিচ্ছেন। এ সব মন্তব্য কুরুচিকর।” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্য বলেন, “আমলারা নন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন সময়ে শাসাচ্ছেন! এ সব কী? মমতা যাদবপুরের কয়েক জন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে আঙুল তুলছেন। উনি সরাসরি অভিযুক্তদের নাম বলুন!”
মুখ্যমন্ত্রী আরও যে সংগঠনের নাম করেছিলেন, সেই মাতঙ্গিনী মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেবলীনা চক্রবর্তী বলেন, “রাজ্য সরকার একটা যুদ্ধ চালাচ্ছে। যুদ্ধে দু’পক্ষের মানুষই মারা যান। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হচ্ছে। যদিও যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের।” তাঁরা সরাসরি মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি করেও দেবলীনার বক্তব্য, “মাওবাদীরা যত ক্ষণ জনস্বার্থে কাজ করছে, তত ক্ষণ আমরা তাদের পক্ষে। কয়েকটি খুন দিয়ে মাওবাদীদের উদ্দেশ্য যাচাই করা ঠিক হবে না।” |