ভাইয়ের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে দাদার স্বীকারোক্তি, “খুব ভুল করেছিলাম।” কী ভুল? মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ‘আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটি’ করা। পাশাপাশি আবেদন, ‘‘ভুল পথে গিয়েই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। আর কেউ যেন ভুল করেও মাওবাদীদের সঙ্গে বা ওই ধরনের কমিটিতে (আদিবাসী মূলবাসী) না যায়।”
কে করছেন আবেদন? ‘আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটি’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, এক সময়ে প্রকাশ্যেই এলাকায় মাওবাদীদের হয়ে প্রচার করা শম্ভু সিংহ। যিনি সদ্য নিজের মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য ভাইকে হারিয়েছেন।
বলরামপুরে সোমবার সন্ধ্যায় তৃণমূল কর্মী রাজেন সিংহ সর্দারের বাবা ও ভাইকে খুন করে পালানোর সময় যৌথ বাহিনীর গুলিতে যে দুই মাওবাদীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁদেরই এক জন শম্ভুবাবুর ভাই বাবলু সিংহ। ঘাটবেড়া গ্রামে বাড়ি। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত অন্য মাওবাদী সুবল মাহাতো আড়শার বাসিন্দা। দুই পরিবারের লোকজন বুধবার পুরুলিয়া হাসপাতালে দেহ দু’টি শনাক্ত করেন। |
২০০৯-এর গোড়ায় বলরামপুরে অঘোর হেমব্রম ও শম্ভু সিংহের হাত ধরে গড়ে ওঠে ‘আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটি’। অঘোরবাবু ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিধানসভা ভোটের আগে অঘোর কমিটি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। গড়ে তোলেন ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’। এই কমিটি প্রকাশ্যে মাওবাদীদের বিরোধিতা শুরু করে। ‘আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটি’র অনেক সক্রিয় সদস্যই ধীরে ধীরে প্রতিরোধ কমিটিতে নাম লেখাতে শুরু করেন। শম্ভুবাবুও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবে অঘোরবাবুদের অভিযোগ ছিল, যেহেতু শম্ভুবাবুর ভাই বাবলু মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডে রয়েছেন, তাই শম্ভুর সঙ্গে এখনও পুরনো কমিটির যোগাযোগ আছে। সেই সূত্রেই সম্প্রতি বলরামপুরে সভা ডেকে শম্ভুবাবুকে ক্ষমা চাওয়ায় প্রতিরোধ কমিটি। সেখানে জোড়হাতে শম্ভুবাবু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। ভাইকে মাওবাদী স্কোয়াড থেকে ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছিলেন।
তা আর হয়নি। এ দিন পুরুলিয়া হাসপাতালের মর্গের সামনে সেই ভাইয়েরই দেহের সামনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি শম্ভুবাবু। বললেন, “আমার সেজো ভাই। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে টিউশন করত। আমরা সিপিএম করতাম না। সিপিএমের লোক ভাইকে প্রায়ই হুমকি দিত। ততদিনে আমিও কমিটির সঙ্গ ছেড়েছি। বছরখানেক আগে এলাকা ছাড়ি। কমিটি তখন ঠিকমতো কাজ করত না। নানা বেনিয়ম হচ্ছিল। সম্পাদক হিসাবে আমি গ্রামবাসীদের জবাব দিতে পারছিলাম না।” শম্ভুবাবুর আক্ষেপ, “আমি এলাকা ছাড়লাম। সেই সুযোগে ওকে মাওবাদীরা জোর করে জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল।” আবার তিনি বলেছেন, “আমরা পাহাড় কোলের বাসিন্দা। মাওবাদীদের কথা না শুনলে বিপদ, ওদের সঙ্গে গেলেও বিপদ। আমরা এখন শান্তি চাই, নিরাপত্তা চাই।” নিহত সুবলের কাকা খাঁদু মাহাতো এ দিন মর্গে ভাইপোর দেহ শনাক্ত করেন। |