তিস্তার জল নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা যত দূর সম্ভব মেটানোর আশ্বাস দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে উত্তরবঙ্গের স্বার্থ বজায় রেখেই।
বুধবার বিকেলে মহাকরণে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণির সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিটের বৈঠকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা বোঝানোর পাশাপাশি তাঁকে বলেছেন, বাংলাদেশের সমস্যা মেটানোর জন্য যত দূর সম্ভব তিনি করবেন। মমতা-দীপু মণির এই আলোচনা তিস্তা চুক্তি নিয়ে বরফ গলানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিল বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত। |
গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরে মমতার উপস্থিতিতেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মমতার আপত্তিতে তা স্থগিত রাখা হয়। মমতা ঢাকা সফরও বাতিল করে দেন। অভিযোগ ওঠে চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া মমতাকে দেখানোই হয়নি। দিল্লির তরফে এই ত্রুটির কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে জল বণ্টন প্রক্রিয়ায় সরাসরি মমতাকে সামিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে যাকে চিনের যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেলের অনুসরণ বলে জানানো হচ্ছে। এই মডেলে আঞ্চলিক কূটনীতির ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনকেই গুরুত্ব এবং দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীপু মণি-মমতা বৈঠকে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে দিল্লি। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার তারিক করিমের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন ভারতের বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের পরিবর্তে তিনিই এখন তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দেখভাল করছেন। দিল্লির সবুজ সঙ্কেত পেয়েই বেঙ্গালুরুতে আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে দেশে ফেরার পথে মমতার সঙ্গে বৈঠক করলেন দীপু মণি।
বৈঠকের পরে মহাকরণে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, “বাংলাদেশকে জল দিতে পারলে আমি খুশি হব। কিন্তু আমাদেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। তিস্তায় অনেক সময় একদম জল থাকে না। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। ও-দিকে সিকিম রয়েছে। চার-পাঁচটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তিস্তা ব্যারেজেরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের মানুষ যাতে জল পান, আর বাংলাদেশের সমস্যাও যতটা মেটানো যায়, সে জন্য যত দূর সম্ভব নিশ্চয়ই করব।”
অন্য দিকে দীপু মণি বলেন, “ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের বিষয়। তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। কিন্তু, ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে কী কথাবার্তা হবে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। তবে পানি-সহ সব ক্ষেত্রেই ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, তিস্তা চুক্তি না হওয়ার ফলে যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, এ দিনের বৈঠকে তার অনেকটাই মিটেছে। মমতা দীপু মণিকে বুঝিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ বা তিস্তা চুক্তির বিরোধী নন। তবে রাজ্যের মানুষকে বঞ্চিত করে চুক্তি করা তাঁর পক্ষে কঠিন। সেই কারণে তিস্তায় কোন সময় কত জল আছে তা দেখতে বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মমতা সাংবাদিকদের বলেন, “বিশেষজ্ঞ কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরে আমরা দু’দেশ কথা বলে
নেব। এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি-বিতর্ক এবং বিকৃতির কোনও সুযোগ নেই। যদিও সম্পর্ক নষ্ট করার লোক রয়েছে। এই লড়াই রাজনৈতিক লড়াই নয়, এটা বন্ধুত্ব অটুট রাখার লড়াই। দু’দেশের সম্পর্ক যাতে খারাপ না হয়, তা আমাদের দেখতে হবে।”
দীপু মণিও মমতাকে বলেছেন, তাঁদের সরকার পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বঞ্চিত করে জল চুক্তি করতেও তাঁরা চাইছেন না। আসলে তিস্তায় জল নেই বলেই সমস্যা। আলোচনার মাধ্যমে তা মেটাতে হবে।
কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রয়োজনে বাংলাদেশের নদী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলবে বলে সরকারি সূত্রের খবর। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কর্তারাও কমিটির সঙ্গে আলোচনা করবেন।
শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দীপু মণির বৈঠক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে হওয়ায় দিল্লি স্বস্তিতে। রঞ্জন মাথাই এ দিনই রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তার পর রিপোর্ট দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। তবে এক বার হাত পোড়ানোর পরে গোটা বিষয়টি নিয়ে খুব সাবধানে এগোতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই কারণে গোড়াতেই মমতা-হাসিনা বৈঠকে না গিয়ে (কলকাতা গিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব আগেই দিল্লিকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) দীপু মণিকে দিয়ে জল মাপার কাজ করা হল বলে বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের মত।
এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসবেন হাসিনা। দীপু মণি নিজেই আজ সে কথা জানিয়েছেন। তখন মমতার সঙ্গে তাঁর কথা হবে। দীপু এ দিন মমতাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। যা উত্তরে দীপু মণিকে ‘বোন’ ও ‘বন্ধু’ বলে সম্ভাষণ করে মমতা বলেছেন, “আজ নয়, বাংলাদেশকে আমি সব সময় ভালবাসি। দীপু মণি আমাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ডিসেম্বর ও মার্চে ওঁদের দু’টি বড় অনুষ্ঠান রয়েছে। সেই সময় আমার পক্ষে সুবিধেজনক হবে কি না, সেটা কথা বলে ঠিক করব।”
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, মমতার সফরের আগেই বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট এসে যাবে। তখন তার ভিত্তিতে দু’পক্ষের মধ্যে আরও সুসংহত আলোচনা সম্ভব।
এ দিনের বৈঠকে দু’দেশের সম্পর্কের ভিতকে দৃঢ় করতে দুই বাংলার মধ্যে আরও বেশি সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের উপরে জোর দেন মুখ্যমন্ত্রী। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে একটি যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রবীন্দ্র-নজরুল আমাদের উভয়েরই সম্পদ। চলচ্চিত্র-নাটক-প্রকাশনা ক্ষেত্রে এবং শিল্পীদের মধ্যে আদানপ্রদান বজায় রাখার ক্ষেত্রে ওই যৌথ টাস্ক ফোর্স কাজ করতে পারে।” |