এক চাষির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে ধানের দাম না পাওয়া এবং মহাজনি ঋণের জেরে আত্মহত্যার অভিযোগ তুললেন তাঁর পরিজনেরা। যদিও স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তা মানতে নারাজ। ঘটনাটি বর্ধমান থানার চান্ডুল গ্রামের। পুলিশ জানায়, মৃতের নাম ভবানী পোড়েল (৪৫)। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ির পিছনে আমগাছে গলায় দড়ির ফাঁসে তাঁকে ঝুলতে দেখা যায়। সেখান থেকে নামিয়ে রাতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে ‘মৃত’ ঘোষণা করা হয়। বুধবার মৃতদেহের ময়না-তদন্তও হয়েছে। মৃতের ভাইপো আশিস পোড়েলের অভিযোগ, বোরো আর আমন চাষ করতে গিয়ে ভবানীবাবুর প্রায় ৫০ হাজার টাকা দেনা হয়েছিল। টাকা শোধ করার জন্য অনবরত চাপ দিচ্ছিলেন মহাজন। অথচ ঘরে মজুত প্রায় ৫০ বস্তা ধান বিক্রি করতে পারছিলেন না তিনি। কারণ একে খোলা বাজারে দাম কম, তার উপরে সরকারের সহায়ক মূল্যে ধান কেনাও বন্ধ। ফলে অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে তিনি আর এই চাপ নিতে পারেননি। আশিসবাবুর কথায়, “সংসার খরচ চালানোর মতো অবস্থাও ছিল না জ্যাঠার। বাধ্য হয়ে জেঠিমাকে ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ করতে হচ্ছিল। সেই কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাওনাদারদের দেনা শোধ করতে না পেরেই জ্যাঠা আত্মঘাতী হয়েছেন।”দুপুরে মৃতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে বস্তা-বস্তা বোরো ধান মজুত। পাঁচ বিঘে জমিতে আমন চাষও হয়েছে। কিন্তু গত বোরো মরসুমে নেওয়া ঋণ শোধ করা দূর অস্ৎ, ভবানীবাবু আরও বেশি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে বাড়ির লোকজনের আক্ষেপ। চাষবাস ছাড়া তাঁর ছেলে বিশেষ কিছু করেন না। ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সন্তানকামনায় এ দিন বাড়িতে কার্তিক পুজো করার কথা ছিল। কিন্তু ভাঁড়ে মা ভবানী। এ নিয়ে স্ত্রী-র সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কিও হয়। ভবানীবাবুর ভগ্নিপতি চণ্ডী পোড়েল ও প্রতিবেশী সুলীল দলুইয়ের খেদ, “উনি কিছুতেই বোরো ধান বিক্রি করতে পারছিলেন না। সরকারি সহায়ক মূল্য ৬৪৮ টাকা বস্তা। অথচ খোলা বাজারে ৫০০ টাকার বেশি দর পাওয়া যাচ্ছে না। চালকলেও ফড়েরাও তার বেশি দর দিতে চাইছিল না। বোরো চাষেই ওঁর কিছু ধার হয়ে গিয়েছিল। তার উপরে আমন চাষ করতে গিয়েও গ্রামের মহাজনদের কাছে প্রায় ৫০ হাজার টাকার দেনা হয়ে যায়। সংসার খরচ টানতে না-পেরেই উনি আত্মঘাতী হয়েছেন।”
ধান বিক্রি করতে না পেরে ঋণের দায়ে চাষি আত্মহত্যা করেছেন, এমন কথা অবশ্য মানতে চাননি স্থানীয় তৃণমূল নেতা মিহির দত্ত। তাঁর দাবি, “ভবানীবাবু মদ খেয়ে নিয়মিত স্ত্রী-র সঙ্গে বচসা করতেন। সাংসারিক অশান্তির জেরেই উনি মারা গিয়েছেন।” স্থানীয় বেলকাশ পঞ্চায়েতের সিপিএম উপপ্রধান গৌতম তা-র পাল্টা দাবি, “আমি যেটুকু শুনেছি, উনি প্রচুর ঋণে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাড়িতে থাকা বস্তাবন্দি ধানও বিক্রি করতে পারেননি। আমাদের এই এলাকায় তো সরকারের সহায়ক মূল্যে ধান কেনার তোড়জোড়ও চোখে পড়েনি। আমরাও ধান কেনার ব্যাপারে সরকারি চিঠি পাইনি। আত্মহত্যার পিছনে রয়েছে এই পরিস্থিতিই।” সিপিএম প্রভাবিত কৃষক সভার জেলা সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল আবার প্রশ্ন তুলেছেন সহায়ক মূল্য নিয়েও। তিনি বলেন, “জেলায় সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা অনেক দিন আগেই চুুকে গিয়েছে। এখন সারের দাম দ্বিগুণ, বিদ্যুতের দামও প্রচুর বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চাষের খরচ। তা এতটাই যে সরকারের বস্তা পিছু ৬৪৮ টাকা দরে ধান কেনা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।”
বর্ধমান (উত্তর) মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “আমরা ঘটনাটির বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছি। পুরোটা না জেনে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে ওই এলাকায় সরাকরি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হয়েছে।” জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা আবার মেনে নেন, সহায়ক মূল্যে ধান কেনার ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম হচ্ছে। এ দিনই রায়না-১ ব্লকের একটি চালকলে গিয়ে তিনি দেখেন, মঙ্গলকোট এবং বাঁকুড়ার পাত্রসায়র থেকে আসা চাষিদের থেকে সরকারি সহায়ক মূল্যের কম দামে ধান কেনা চলছে। একটি ট্রাক্টর থেকে এমন সরকারি মূল্যের কমে কেনা ৯১ বস্তা ধান আটকও করা হয়েছে। ভাতারেও ধান কেনা নিয়ে কিছু অভিযোগ মিলেছে। চালকলের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন জেলাশাসক। তবে তাঁর বক্তব্য, “চাষির আত্মহত্যার খবর পেয়ে আমি বিডিও-কে মৃতের বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। বিডিও ওই বাড়িতে গিয়ে অবিক্রিত ধান খুঁজে পাননি। পুলিশ তদন্ত করছে।” |