|
|
|
|
যাননি বাঘা যতীনে |
নির্দেশ লঙ্ঘনের নজির ফের গড়লেন তিন ডাক্তার |
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ ফের অমান্য করলেন কয়েক জন সরকারি চিকিৎসক। এমনকী, এক ডাক্তারের বদলি আটকাতে ‘প্রভাবশালী মন্ত্রী’-র ফোনও গেল হাসপাতালের সুপারের কাছে!
সব মিলিয়ে ফের প্রশ্নের মুখে পড়ল রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসন।
নিয়মভঙ্গের অভিযোগে গত সোমবার বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে মেডিসিনের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সাসপেন্ড করা হয়। পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে এমআর বাঙুর হাসপাতালের এক ডাক্তারকে ‘ডেপুটেশনে’ বাঘা যতীনে যাওয়ার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য দফতর। পাশাপাশি আরও কয়েকটি হাসপাতাল থেকেও কয়েক জন চিকিৎসককে বাঘা যতীনে যাওয়ার সরকারি নির্দেশ জারি হয়।
নির্দেশই সার। এক সপ্তাহ পরেও এঁদের কেউ বাঘা যতীনে যোগ দেননি। ফলে সেখানে পরিষেবা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বন্ধ করে দিতে হয়েছে মেডিসিনের আউটডোর।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর: ‘মত্ত’ অবস্থায় ডিউটি করার অভিযোগে বাঘা যতীনে মেডিসিনের চিকিৎসক প্রবীরকুমার ঘোষকে গত সোমবার সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব সামলাতে বলা হয়েছিল বাঙুর হাসপাতালের চিকিৎসক তপন মণ্ডলকে। গত সোমবার সুপারের থেকে ওই নির্দেশ পাওয়ার পরেই তপনবাবু জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে বাঘা যতীনে যাওয়া সম্ভব নয়, তিনি বাঙুরেই থাকবেন। শুধু তিনি নয়। বাঘা যতীন স্টেট জেনারেলে পরিষেবা চাঙ্গা করতে বেহালা বিদ্যাসাগর হাসপাতালের যে দু’জন এবং নর্থ সাবার্বান হাসপাতালের যে এক জন ডাক্তারকে ওখানে যেতে বলা হয়েছিল, বেঁকে বসেন তাঁরাও। তিন জনই জানিয়ে দেন, তপনবাবু না-গেলে তাঁরাও যাবেন না।
সরকারি ডাক্তার হয়ে সরকারি নির্দেশ অমান্যের দৃষ্টান্ত অবশ্য এই প্রথম নয়। কিছু দিন আগে এমআর বাঙুরে ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরা সরকারি নির্দেশের তোয়াক্কা না-করে ঘোষণা করেছিলেন, রবিবার ও ছুটির দিনে তাঁরা ব্লাড ব্যাঙ্ক বন্ধ রাখবেন। তার রেশ না-মিটতেই ফের একই ঘটনায় রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘বিশৃঙ্খল’ ছবিটাই প্রকট হয়ে উঠল বলে চিকিৎসক মহলের একাংশ মনে করছেন। স্বাস্থ্য-প্রশাসনের কী বক্তব্য?
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর কথা বলা সত্ত্বেও এ হেন ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে স্বাস্থ্যকর্তারা বিচলিত ও ক্ষুব্ধ। রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা শ্যামাপদ বসাকের প্রতিক্রিয়া, “এ অকল্পনীয়। অমার্জনীয়ও। নির্দেশ না-মানলে কড়া শাস্তি হবে।”
তা হলে এত দিন পরেও কোনও ব্যবস্থা হল না কেন?
এম আর বাঙুরের সুপার কাজলকৃষ্ণ বণিকের ব্যাখ্যা, “যে দিন ওঁকে বাঘা যতীনে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, তার ঠিক পর দিন সকালে আমার কাছে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ফোন আসে। তিনি আমাকে বলেন, তপনবাবুর বাঘা যতীনে যাওয়া আটকাতে হবে। কী করব বুঝতে না-পেরে স্বাস্থ্যভবনকে ব্যাপারটা জানাই। স্বাস্থ্যভবন থেকে আমাকে বলা হয়, আগের নির্দেশের নড়চড় হবে না। আমি তপনবাবুকে তা জানিয়েও দিয়েছি। তবু তিনি অনড়।”
তপনবাবুর কী বক্তব্য?
ওই চিকিৎসক বলেন, “আমি চেস্ট মেডিসিনের ডাক্তার। ১৯৮৫ থেকে চেস্ট মেডিসিনই প্র্যাক্টিস করছি। জেনারেল মেডিসিনে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমি চলে গেলে বাঙুরের চেস্ট মেডিসিন বিভাগ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, আমিই সেখানে একমাত্র ডাক্তার।” তপনবাবু এ-ও জানিয়ে দিচ্ছেন, “এর পরেও আমাকে জোর করে পাঠানো হলে বাঘা যতীনের সুপারকে জানিয়ে দেব, আমার চিকিৎসায় কোনও রোগীর কোনও অঘটন ঘটলে আমি দায়ী থাকব না।”
বাঙুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য তপনবাবুর যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য: তপনবাবু চলে গেলে বাঙুরে মেডিসিনের অন্য ডাক্তারেরাই চেস্ট মেডিসিন সামলাবেন। কারণ, চেস্ট মেডিসিনে রোগী আসেন খুব কম। স্বাস্থ্য-কর্তারাও তপনবাবুর দাবি নস্যাৎ করে বলছেন, “কোনও চেস্ট মেডিসিনের ডাক্তার যদি বলেন যে, তিনি জেনারেল মেডিসিনের কাজ পারেন না, তা হলে তো তাঁকে মেডিক্যাল কাউন্সিলে জবাবদিহি করতে হবে!”
নির্দেশ লঙ্ঘনকারীর যুক্তি সব কর্তৃপক্ষই একবাক্যে উড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ এত দিনেও তাঁর শাস্তি হল না! কেন?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য-অধিকর্তা শিখা অধিকারী বলেন, “সোমবার থেকে তপনবাবু কী করেন, দেখব। নির্দেশ ভঙ্গ করলে কড়া শাস্তি পেতে হবে।”
এই টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে বাঘা যতীনের হাল বেহাল।
পাঁচ মাস আগে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যে হাসপাতাল পরিদর্শন করে আউটডোর রোজ ঠিক সময়ে খোলার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই বাঘা যতীন স্টেট জেনারেলে গত এক সপ্তাহ যাবত মেডিসিন আউটডোরই বন্ধ! কারণ, কোনও ডাক্তার নেই! বাঘা যতীনের সুপার সুপার বিকাশ মণ্ডলের আক্ষেপ, “মেডিসিনের ডাক্তারের অভাবে ওই বিভাগে ইন্ডোরে রোগী ভর্তি প্রায় হচ্ছেই না। যাঁরা ভর্তি, তাঁদের কারও অসুস্থতা বাড়লে অন্য জায়গায় রেফার করে দেওয়া হচ্ছে। এ ভাবে একটা হাসপাতাল চলতে পারে না!” |
|
|
|
|
|