অবশেষে কাঠামোয় ‘পরিবর্তন’! সুভাষ চক্রবর্তী, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়দের দল যে ‘সুযোগ’ দেয়নি, নকুল মাহাতো, চণ্ডী পালদের ক্ষেত্রে তা দিতে চাইছে সিপিএম!
জেলায় জেলায় বয়সের ভারে অশক্ত বা শারীরিক ভাবে অসুস্থ নেতাদের এ বার সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়ায় হাত দিতে পারবে আলিমুদ্দিন। দলের কোনও কমিটির সম্পাদক পদে সর্বোচ্চ তিন দফার মেয়াদ বেঁধে দিয়ে অশক্ত এবং অক্ষম নেতাদের জেলা ও রাজ্য সম্মেলনের আগে প্রয়োজনীয় ‘বার্তা’ দিয়ে রাখল সিপিএম। এর আগে গুরুতর ভাবে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও সুভাষবাবু, মৃণালবাবুর মতো মন্ত্রীদের দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়নি। সুস্থ শরীরে কাজ করতে সক্ষম না-হয়েও তাঁরা আমৃত্যু মন্ত্রী থেকে গিয়েছেন। কিন্তু সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি এ বার যে প্রস্তাব পাশ করেছে, তাতে জেলা তথা অন্যান্য কমিটির সম্পাদকদের পদ থেকে ‘রেহাই’ দিতে বিশেষ বাধা থাকছে না। প্রথমে লোকসভা এবং তার পরে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল, দুই রাজ্যে বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে সিপিএমের অসুস্থ নেতাদের পদ থেকে সরিয়ে ফেলার ‘বোধোদয়’ হল বলে দলেরই একাংশের অভিমত।
জেলা সম্পাদক পদে বেশ কিছু রদবদলের প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে রাজ্য সিপিএমে। কিন্তু নানা ‘বাধ্যবাধকতা’র কারণে সেই সব প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি এ বার দলের নেতৃস্থানীয় পদে নতুন রক্ত আমদানির বাতাবরণ তৈরি করে দিল বলে সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা। এখন এ রাজ্যে ১৯টি জেলার মধ্যে ১৫টিরই জেলা সম্পাদক তিন বার বা তার বেশি ওই পদে রয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবকে সামনে রেখে এ বার সরে দাঁড়ানোর জন্য তাঁদের উপরে ‘চাপ’ সৃষ্টি করা যাবে বলে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব মনে করছেন। ভবিষ্যতের কথা ভেবে দলকে ‘গতিশীল’ করার পথেও এগোনো যাবে। স্বভাবতই আপাতত ‘স্বস্তি’তে আলিমুদ্দিন।
সিপিএমেরই একাংশের মতে, কেন্দ্রীয় কমিটির ওই প্রস্তাবকে ব্যবহার করেই প্রবীণ এবং দীর্ঘ মেয়াদের জেলা সম্পাদক-সহ সর্ব স্তরের কমিটির সম্পাদকদের ‘সম্মানজনক’ ভাবে সরে দাঁড়ানোর পথ করে দেওয়া যাবে। ওই প্রস্তাবকে সামনে রেখে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দেখাতে পারবেন কোনও নেতার উপরে ‘অনাস্থা’ দেখানো হল, বিষয়টি এমন নয়। দল যে বিধি চালু করতে চাইছে, তার প্রতি সম্মান দেখিয়েই পুরনো নেতাদের সরে যেতে হল। যে হেতু এ বারের রাজ্য ও জেলা সম্মেলনে তিন বারের মেয়াদ সংক্রান্ত রূপরেখা ‘বাধ্যতামূলক’ থাকছে না, সেই জন্য ‘সম্মানজনক’ ভাবেই অসুস্থ নেতাদের জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসার সুযোগ থাকছে বলে এ কে জি ভবন এবং আলিমুদ্দিনের
একাংশের ব্যাখ্যা।
কেন্দ্রীয় কমিটি যে প্রস্তাব পাশ করেছে, তা আলোচনার জন্য ফেলা হবে আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে। সেখানে প্রস্তাবটি গৃহীত হলেই তা সিপিএমের গঠনতন্ত্রে গৃহীত হবে। পার্টি কংগ্রেস হবে আগামী বছরের এপ্রিলে। কিন্তু এ রাজ্যে জেলা সম্মেলন হবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। তার পরে ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় বসবে রাজ্য সম্মেলন। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছিল। এ বার তা নির্দিষ্ট রূপ পেল। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত হওয়ার আগে বিধি হিসাবে তা তো আগাম কার্যকর হতে পারে না।”
তা হলে ‘মেয়াদ-উত্তীর্ণ’ জেলা সম্পাদকেরা কি স্বপদে বহাল থাকবেন? কেন্দ্রীয় কমিটির ওই নেতার ব্যাখ্যা, “সে ক্ষেত্রে রাজ্য ও জেলা সম্মেলনে সকলেই বুঝতে পারবেন, দল কোন পথে এগোতে চাইছে। সেইমতোই সিদ্ধান্ত হবে। তবে তিন বার হয়ে গিয়েছে বলেই কেউ আর নির্বাচিত হতে পারবেন না, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা এ বার অন্তত থাকছে না।” অর্থাৎ তিন দফা বা তার বেশি পদে থাকলেও কোনও সম্পাদক ‘ভাল কাজ’ করলে তাঁকে রেখে দেওয়ার জন্য কাগজে-কলমে একটি রাস্তা খোলা থাকছে। তাঁদের ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হবে, তিন বারের মেয়াদ নির্দিষ্ট করার ‘বিধি’ কার্যকর হয়নি।
তবে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত, ‘বিধির ফাঁক’ গলে জেলা সম্পাদক থেকে যেতে পারেন, এমন সম্ভাবনা আছে হাতে-গোনা কিছু নেতার। বয়স এবং শরীরের কথা বলে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সময়ে দলের কাছে ‘অব্যাহতি’ চেয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার অমিতাভ বসু, মালদহের জীবন মৈত্র, জলপাইগুড়ির মানিক সান্যাল। এর মধ্যে অমিতাভবাবু পুরুলিয়ার নকুল মাহাতোর (টানা ১০ দফা) পরে সব চেয়ে বেশি দফায় জেলা সম্পাদক রয়েছেন ৮ দফা। এই চার জন ছাড়াও তিন বা তার বেশি দফায় জেলা সম্পাদক পদে আছেন হুগলির বিনোদ দাস, কোচবিহারের চণ্ডী পাল, দার্জিলিঙের সাঙ্গোপাল লেপচা, দক্ষিণ দিনাজপুরের মানবেশ চৌধুরী, উত্তর দিনাজপুরের বীরেশ্বর লাহিড়ী, বাঁকুড়ার অমিয় পাত্র, বীরভূমের দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়, বর্ধমানের অমল হালদার, নদিয়ার আশু ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুরের দীপক সরকার এবং কলকাতার রঘুনাথ কুশারী। এঁদের মধ্যে নকুলবাবু, বিনোদবাবু, চণ্ডীবাবুরা বয়স ও শারীরিক কারণে যতটা ভারাক্রান্ত, অমিয়বাবু, অমলবাবু, মানবেশবাবু বা দীপকবাবাবুরা তা নন। কিন্তু ‘এক যাত্রায় পৃথক ফলে’র প্রশ্ন তুলে দলের একাংশ যেমন তাঁদেরও ‘অব্যাহতি’ দেওয়ার কথা সম্মেলনে তুলতে পারে, তেমনই আবার ‘বিধি’ চালু না-হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে তাঁদের রেখে দেওয়ার পক্ষেও বলতে পারে একাংশ।
তিন বারের মেয়াদের নিরিখে দেখলে সিপিএমের জেলা সম্পাদকদের মধ্যে ‘ছাড়’ পাওয়ার কথা চার জনের। মুর্শিদাবাদে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য জেলা সম্পাদক হয়েছেন মাত্রই মাসদুয়েক আগে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুজন চক্রবর্তী সওয়া এক বছর আগে। হাওড়ার বিপ্লব মজুমদারও জেলা সম্পাদক হয়েছেন বছরদুয়েক আগে। এ ছাড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের কানু সাহুর গত সম্মেলন থেকে জেলা সম্পাদক হিসাবে এটাই প্রথম দফা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “প্রবীণ ও নবীনে ভারসাম্য রেখেই নতুন কমিটি গড়া হবে। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাব যে হেতু ভবিষ্যতের দিশা বেঁধে দিচ্ছে, তাই সেই অনুযায়ী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।” অর্থাৎ ‘অপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নিতে এ বার ওই ‘দিশা’কেই হাতিয়ার করতে পারবে আলিমুদ্দিন।
|
দীর্ঘমেয়াদি জেলা সম্পাদক |
পুরুলিয়া |
মালদহ |
উঃ ২৪ পরগনা |
জলপাইগুড়ি |
কোচবিহার |
|
|
|
|
|
নকুল মাহাতো
১৯৬৪ থেকে।
১৭ দফা |
জীবন মৈত্র
১৯৮১ থেকে।
৮ দফা |
অমিতাভ বসু
১৯৮৮ থেকে।
৮ দফা |
মানিক স্যানাল
১৯৮৭ থেকে।
৬ দফা |
চণ্ডী পাল
১৯৯১ থেকে।
৫ দফা |
|
উত্তর দিনাজপুর |
দার্জিলিং |
দক্ষিণ দিনাজপুর |
হুগলি |
বাঁকুড়া |
|
|
|
|
|
বীরেশ্বর লাহিড়ি
১৯৯২ থেকে।
৫ দফা |
বীরেশ্বর লাহিড়ি
১৯৯২ থেকে।
৫ দফা |
মানবেশ চৌধুরী
১৯৯২ থেকে।
৫ দফা |
বিনোদ দাস
১৯৯৪ থেকে।
৫ দফা |
অমিয় পাত্র
১৯৯৫ থেকে।
৫ দফা |
|