|
|
|
|
সাধারণ সম্পাদকের মেয়াদ তিন দফায় বেঁধে
আরও এক বার গদি নিশ্চিত করছেন কারাট |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
সাধারণ সম্পাদকের মেয়াদ তিন দফায় বেঁধে দিতে চলেছে সিপিএম। আজ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এই নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের পরে প্রকাশ কারাট এ কথা জানিয়েছেন। শুধু সাধারণ সম্পাদকই নয়, একই মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হবে দলের সর্ব স্তরের সব সম্পাদকের ক্ষেত্রেই। পাঁচ মাস পরে কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে এই নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
এই নীতিগত সিদ্ধান্তের ফলে আগামী ২০১৫ সাল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন প্রকাশ কারাট। যার অর্থ, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও সিপিএম লড়বে তাঁরই নেতৃত্বে। যা দেখেশুনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, সঙ্কট যতই তীব্র হোক, পার্টি কংগ্রেসের পাঁচ মাস আগে কেন্দ্রীয় কমিটিকে পাশে নিয়ে দলের মধ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ একটি রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধিই করে ফেললেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক।
আগামী এপ্রিলে কোঝিকোড়ের পার্টি কংগ্রেসে সিপিএম যে সাধারণ সম্পাদক পদে সর্বোচ্চসীমা বেঁধে দিতে চলেছে, সেই রীতি কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে সিপিআইয়ে ইতিমধ্যেই চালু আছে। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পরে কারাট নিজেই আজ জানিয়েছেন, এক ব্যক্তি সর্বাধিক তিন দফায় সাধারণ সম্পাদক থাকতে পারবেন। তবে শুধু সাধারণ সম্পাদকই নন, রাজ্য, জেলা থেকে শুরু করে একেবারে নীচের স্তর পর্যন্ত সমস্ত সম্পাদক পদেই এই তিন দফার সর্বোচ্চ মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। তিন বছর অন্তর পার্টি কংগ্রেস হয়। সেই হিসেবে এক জন নেতা সম্পাদক পদে সর্বোচ্চ ৯ বছর থাকতে পারবেন।
দলের মধ্যে কারাট-বিরোধী শিবিরের মতে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘নিজে বাঁচুন ও অন্যকে বাঁচান’ তত্ত্বকেই ফের প্রতিষ্ঠিত করলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কারাটের আমলে দল ধারাবাহিক ভাবে ব্যর্থতার মুখে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিপর্যয় তার শেষতম উদাহর। ফলে আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে কারাটের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। আগামী পার্টি কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কারাটের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শেষ হবে। তিন দফা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে আর একটি দফার পরে তিনি আর গদি আঁকড়ে থাকতে চান না এই ‘বার্তা’ দিয়েই পরের তিন বছরের জন্য নিজের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করে ফেলতে পারবেন কারাট।
একই ভাবে, রাজ্যে বাম সরকারের পতনের ‘দায়’ বিমান বসুও এড়াতে পারেন না। কিন্তু কারাটের এই ‘চালে’ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক পদে বিমানবাবুরও পুনর্নির্বাচিত হওয়ার অসুবিধা থাকল না। কারণ, ২০০৬ সালে অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর আর এক বারই ফের নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
কারাট শিবিরের বক্তব্য, অতীতে পি সুন্দরাইয়া, ইএমএস বা হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎরা এক এক জন দলের সর্বোচ্চ পদে ১৩ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত ছিলেন। সে জায়গায় কারাট মাত্র ৯ বছর থাকার কথা বলছেন। তা ছাড়া, সর্বাধিক তিন দফার মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হলেও প্রথম দফার পরেই দল চাইলে কাউকে ‘সরিয়ে’ দিতে পারে। ঘটনা হচ্ছে, ২০০৫ সালের পার্টি কংগ্রেসে, যে বারে কারাট সাধারণ সম্পাদক পদে প্রথম বারের জন্য নির্বাচিত হন, কেরলের সদস্য কে এন বালগোপাল সর্বোচ্চসীমা বেঁধে দেওয়া নিয়ে একটি প্রস্তাব এনেছিলেন। তখন কারাটরাই কিন্তু সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেন। আজ এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কারাটের জবাব, “আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিই। এখন মনে হচ্ছে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এর ফলে সংগঠনকে ঢেলে সাজা যাবে।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “নতুন নেতৃত্ব তুলে আনা দরকার। এই সিদ্ধান্তে সেটা ভাল ভাবে করা সম্ভব হবে।”
এখন সঙ্কটের পরিস্থিতিতে দলে যে নতুন রক্ত এবং আরও বেশি তারুণ্য
প্রয়োজন, তা-ও মেনে নিয়েছেন কারাট। নেতৃত্বের বক্তব্য, তিন দফার মেয়াদ বেঁধে দেওয়া রয়েছে জানা থাকলে সময় থাকতেই পরবর্তী নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে যাবে। যিনি সরে যাবেন, তিনিও পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি, রাজ্য বা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে থেকে দলকে ‘পরামর্শ’ দিতে পারবেন। কারণ, ওই সব পদে কোনও মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না। কারাটের নিজের কথায়, “এর ফলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে। সম্মিলিত কর্মসূচি
মজবুত হবে।”
মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। ঠোঁট ও পেয়ালার মধ্যে এখনও কিছুটা ফারাক রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, সমস্ত সম্পাদক পদে মেয়াদের সর্বোচ্চসীমা বেঁধে দেওয়ার জন্য দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে। পলিটব্যুরোকে সেই সংশোধনীর খসড়া তৈরি করতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে তা পাশ করাতে হবে। তার পরে তা পার্টি কংগ্রেসে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। প্রশ্ন উঠেছে, পার্টি কংগ্রেসের আগেই কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত আগাম ঘোষণা করে দেওয়া হল কেন?
|
নতুন নেতৃত্ব তুলে আনা দরকার।
এই সিদ্ধান্তে সেটা ভাল ভাবে করা যাবে। প্রকাশ কারাট |
প্রথম নির্বাচিত |
২০০৫ |
কত দফা |
দুই দফা |
কত বছর পদে |
৬ বছর |
(এখনও পর্যন্ত) |
|
|
|
|
|
|
|
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক |
পি সুন্দরাইয়া |
ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ |
হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ |
প্রথম নির্বাচিত |
১৯৬৪ |
১৯৭৮ |
১৯৯২ |
কত দফা |
তিন দফা |
চার দফা |
চার দফা |
কত বছর পদে |
১৪ বছর |
১৪ বছর |
১৩ বছর |
|
কারাট শিবিরের বক্তব্য, পার্টি কংগ্রেসকে সামনে রেখে লোকাল কমিটি থেকে শুরু করে রাজ্য কমিটি পর্যন্ত সমস্ত স্তরেই সম্পাদক পদে নির্বাচন হবে। এখন কেউ যদি পার্টি কংগ্রেসের আগে চতুর্থ বা পঞ্চম বারের জন্য কোনও নিম্নতর কমিটির সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন, তা হলে মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার পরে কি তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে? কারাটরা অবশ্য সে কথা বলছেন না। তাঁদের বক্তব্য, কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে কী হতে চলেছে, আগেভাগেই তার আঁচ পেয়ে যাওয়ায় ওই সব ব্যক্তির উপরে ‘চাপ’ তৈরি হবে। ফলে, তাঁরা নিজেরাই ফের গদিতে বসার চেষ্টা না-করে নতুন মুখ তুলে ধরতে ‘বাধ্য’ হবেন। কারাট শিবিরের যুক্তি, এক পদে থাকলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ‘প্রলোভন’ এড়ানো কঠিন হয়। দলের নেতাদের মধ্যে কমিউনিস্ট আদর্শ থেকে ‘বিচ্যুতি’র প্রবণতা তৈরি হয়। তাই সম্পাদক পদে সর্বোচ্চ মেয়াদ বেঁধে দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দলের সম্পাদকদের পদের মেয়াদ যেখানে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, রাজ্যসভার ক্ষেত্রেও যেখানে পরপর দু’বার নির্বাচিত তৃতীয় বার আর প্রার্থী হওয়ার নিয়ম নেই সিপিএমে, সেখানে লোকসভা থেকে শুরু করে কোনও ভোটের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয় না কেন? এর জবাবে কারাট জানান, লোকসভা থেকে পঞ্চায়েত, সব ক্ষেত্রেই কিন্তু তিন দফার নিয়মটি চালু আছে। কিন্তু সব সময় সেটা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। ব্যতিক্রমী ও ছাড় থাকেই। তাঁর বক্তব্য, যিনি এলাকায় জনপ্রিয়, তাঁর ক্ষেত্রে ছাড় তো দিতেই হবে। আর ব্যতিক্রম? কারাটের জবাব, “কমরেড জ্যোতি বসুর মেয়াদ কি বেঁধে দেওয়া সম্ভব ছিল?”
মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মে মাসে বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকেই মত জানাতে শুরু করেছিলেন কারাট। যুক্তি দিয়েছিলেন, কিউবার কমিউনিস্টরাও এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। তিনি নিজেও দলকে এই প্রস্তাব দিচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন কারাট। ফলে, দলের মধ্যে জনমত গঠনের কাজটা আগেই শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। দলীয় সূত্রের খবর, ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই সাধারণ সম্পাদক পদে মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। তবে তখন প্রস্তাব উঠেছিল, সমস্ত সম্পাদক পদে দু’দফার মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হোক। তখনই দলের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভের আঁচ পান কারাট। কারাট-বিরোধী শিবিরের যুক্তি, সেই ক্ষোভ ‘অযৌক্তিক’ নয়। পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহার, মায়াবতীকে সামনে রেখে লোকসভার আগে তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা, তার পরে পশ্চিমবঙ্গে হার, কেরলে হার সত্ত্বেও কারাট-বিরোধী ভি এস অচ্যুতানন্দনের ‘জাদু’তে দলের ভাল ফল করা এর কোনওটারই দায় দলের কাণ্ডারী এড়িয়ে যেতে পারেন না। বিদায় তাঁকে নিতেই হত। কিন্তু দু’দফার বদলে তিন দফার মেয়াদ বেঁধে দিয়ে বিক্ষুব্ধদের অস্ত্রকেই ঢাল করলেন তিনি। আরও এক দফা সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা ‘সুনিশ্চিত’ করা গেল। আবার তিনি গদি আঁকড়ে থাকতে চান না, সেই ‘বার্তা’ও দেওয়া গেল। পরের বার সরতে হলেও তিনি দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে সরে যাচ্ছেন এই কথা বলার জায়গা তৈরি হল।
এই সূত্রে নিজের ‘গদি বাঁচানোর’ যে অভিযোগ উঠছে, তা-ও নস্যাৎ করে দিয়েছে কারাট শিবির। তাদের যুক্তি, কেরলের সাধারণ সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন তো ১৯৯৮ সাল থেকে ওই পদে রয়েছেন। শীঘ্রই তাঁর চতুর্থ দফা পূর্ণ হবে। এখন নতুন নিয়ম হলে কারাট ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই সিপিএম নেতার পদ নিয়েই তো টানাটানি পড়ে যাবে। তা হলে কারাট নিজের এবং অন্যের গদি বাঁচাতে চাইছেন, এই অভিযোগ উঠছে কোথা থেকে?
এই শিবির সূত্রেরই বক্তব্য, কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিন দফার মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত হলেও দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধনী তৈরির সময় খুঁটিনাটি দিকগুলি ঠিক হবে। সেখানে বলা হবে, দু’দফার পরে তৃতীয় দফার পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিটির ৭৫% সদস্যের সমর্থন লাগবে। একই সঙ্গে ওই কমিটির উপরের স্তরের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। কারাট-বিরোধীদের বক্তব্য, সেখানেও কারাটের ফের গদিতে বসার কোনও সমস্যা নেই। কারণ ওই নিয়ম প্রযোজ্য হবে পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে। তবে কারাট-বিরোধী শিবিরের অভিমত যা-ই হোক না কেন, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কিন্তু কেউই এ নিয়ে সরব হননি। গত তিন দিনে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনার মূল বিষয় ছিল মতাদর্শগত দলিল। সেই দলিলের খসড়া তৈরি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে পেশ করার দায়িত্ব ছিল সীতারাম ইয়েচুরির। সেই দলিল নিয়ে ইয়েচুরি যখন ব্যস্ত, ঠিক তখনই পলিটব্যুরোর তরফে সম্পাদক পদে মেয়াদের সর্বোচ্চসীমা বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে হেতু
এখন কারাটের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন, তাই সেই প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়।
|
ছবি: পি টি আই |
|
|
|
|
|