সিএবি ক্লাব হাউসের টঙে খোদাই হয়ে রয়েছে যেন তাঁদের অক্ষয় কীর্তি। বিশ্বকাপ হাতে কপিল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হাতে ধোনি। সচিন। সৌরভ। এঁদের পাশাপাশি তাঁরা। দশ বছর আগের তাঁদের সেই পার্টনারশিপ আজও বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের বরেণ্য পার্টনারশিপগুলোর অন্যতম। স্মৃতি-বিজড়িত সেই ইডেনে আবার ওঁরা ফেরত। যে মাঠে এক জনের গড় ৯৪। এক জনের ৬৪। কে বলতে পারে এ মাঠে শেষ বারের মতো জুড়িরা একসঙ্গে নন! এখন তো তাঁদেরও বয়স হয়েছে।
তিনি রাহুল দ্রাবিড়। তিনি ভিভিএস লক্ষ্মণ।
তাজ বেঙ্গল হোটেলের তিন তলার ঘরে বসে শনিবার রাতে জুড়িতে তাঁরা রোমন্থন করলেন অমর সেই ম্যাচ। এক্সক্লুসিভ উত্তর দিলেন আরও অনেক প্রশ্নের।
ইডেনের টঙে নিজেদের ছবি দেখা
দ্রাবিড়: দারুণ লাগল দেখে। একটা হালকা নস্ট্যালজিয়াও হল। এ মাঠের সব বরণীয় অধ্যায়কে এ ভাবে খোদাই করে রাখাসিএবি-র এই আইডিয়াটা আমার দারুণ লেগেছে। ভারতের আর কোনও অ্যাসোসিয়েশনে কিন্তু আমি এ জিনিস দেখিনি। দেখে বেশ তৃপ্ত লাগল যে, এমন একটা জিনিসের ভাগীদার ছিলাম সেটা আজ সসম্মানে সাজিয়ে রাখা।
লক্ষ্মণ: আমি আইপিএল খেলতে আসার সময়েই এটা দেখেছিলাম। আজকে নয়। তবে আবার আজ দেখলাম। আমি আর রাহুল ওখানেঅনুভূতিটা গ্রেট!
দশ বছর আগের অমর সেই স্মৃতি ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে ফিরে আসা
দ্রাবিড়: আমি পিছন ফিরে মধুর রোমন্থনে খুব বিশ্বাসী নই। তবু যত বার এখানে আসি, প্রতিবার কেউ না কেউ মনে করিয়ে দেয়। যদি ফিরে দেখা বলেন, আমি আমাদের পার্টনারশিপের চেয়েও বেশি বলব শেষ দিনের দুপুরটা। যখন আমরা বোলিং করছিলাম। বিশেষ করে আমার কাছে ফিরে আসে বিকেলের দিকটা। যে ম্যাজিকটা আমাকে আজও বিহ্বল করে রেখেছে। যার কোনও ব্যাখ্যা পরবর্তীকালেও পাইনি। উত্তাল জনতা চেঁচাচ্ছে উইকেটের জন্য। ক্রমশ আরও বেশি প্যাশনেট হয়ে পড়ছে। ও দিকে হরভজন ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। পরপর পড়ছে অস্ট্রেলিয়ার উইকেট। এখনও আমার স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে চায়ের পর অস্ট্রেলিয়ার সাত উইকেট পড়া। প্রত্যেকটা বলে উইকেট চেয়ে ইডেন-জনতার চিৎকার ভাবলে এখনও আমার লোম খাড়া হয়ে যায়।
লক্ষ্মণ: ওই টেস্টটার কথা ভাবলে সব সময়ই রোম্যান্টিক হয়ে পড়ি। আমার খেলা গ্রেটেস্ট টেস্ট ম্যাচ! সিরিজটাও বোধহয় তাই ছিল। আগাগোড়া রোমহর্ষক। চেন্নাইয়ের টেস্ট ম্যাচটাও অসম্ভব উত্তেজক ছিল। ইডেনে যখন শেষ দিকে ওদের উইকেটগুলো পড়ছিল, হৃৎপিণ্ড প্রায় গলায় এসে যাচ্ছিল।
|
লক্ষ্মণের ২৮১
দ্রাবিড়: কোনও ভারতীয়র খেলা অন্যতম গ্রেটেস্ট ইনিংস! যদি না গ্রেটেস্টই হয়ে থাকে। দুর্ধর্ষ খেলেছিল ও। আমি উইকেটের উল্টো দিক থেকে অবাক হয়ে শুধু দেখে গিয়েছিলাম।
লক্ষ্মণ: ফার্স্ট ইনিংসের পর অপরাজিত থেকে ফিরছি। জন রাইট আমাকে বলল, প্যাডটা খুলো না। তোমাকে এ বার ওয়ান ডাউন যেতে হবে। সে বার আমি খুব ভাল ফর্মে ছিলাম। রঞ্জি ট্রফিতে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলাম। হায়দরাবাদের হয়ে খেলছিলাম তিন নম্বরে। সাউথ আফ্রিকাতেও তিন নম্বর খেলেছি। আমার মানাতে কোনও অসুবিধাই হয়নি।
দ্রাবিড়: দশ বছর আগে ওটা তখন এমন একটা সময় ছিল যখন আমরা দু’জনেই নিজেদের খ্যাতি তৈরি করছিলাম। তখনও যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত হইনি।
লক্ষ্মণ: রাহুলের সঙ্গে আমার একটা দুর্ধর্ষ পার্টনারশিপ ছিল অ্যাডিলেডে। একই রকম চাপ। টিম খারাপ অবস্থায়। তার মধ্যে আমরা টিমকে ট্রিপল সেঞ্চুরি পার্টনারশিপে টেনে তুলেছিলাম। রাহুলকে নিয়ে নতুন কিছু বলার প্রয়োজন নেই। লাস্ট টেস্টেও কোটলাতে ওর আর সচিনের এত ভাল পার্টনারশিপ না হলে আমরা টেস্টটা জিততাম না। আমি তো নেমেছিলাম অনেক পরে। ততক্ষণে ওদের জুড়ি আসল প্রেশারটা নিয়ে নিয়েছে। লোকের স্কোরকার্ড দেখে মনে হয়েছে, সহজ জয়। আদৌ সহজ ছিল না।
লম্বা পার্টনারশিপের সময় অস্ট্রেলিয়ানদের মিষ্টি মিষ্টি কথা
দ্রাবিড়: প্রচণ্ড গরম ছিল দিনটা। তাতে অস্ট্রেলিয়ানদের অসুবিধাই হয়। প্লাস আমরা যে ওদের এমন প্রেশারে ফেলব ওরা ভাবতেই পারেনি। যত খেলা গড়াচ্ছিল ততই ওদের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, আরও চাপে পড়ে যাচ্ছে। স্লেজিং খুব একটা করেছিল বলে মনে পড়ছে না।
লক্ষ্মণ: আরে, শুধু সে দিন কেন? অস্ট্রেলিয়ানরা কখনওই আমাকে সে ভাবে স্লেজিং করেনি। আর ইডেনের পার্টনারশিপের দিন আমরা শুধু নিজেদের কাজটা নিয়েই চিন্তিত ছিলাম। খুব বেশি আগেও ভাবিনি। আশেপাশে কে কী বলছে, তাও শুনিনি। গোটা প্ল্যানিং ছিল বল বাই বল। সেশন বাই সেশন।
দ্রাবিড়: এগজ্যাক্টলি। বল বাই বল। সেশন বাই সেশন ছিল। আমি আর একটা জিনিস মনে করতে পারি। ড্রেসিংরুমে সৌরভ-সচিনের টিমকে চাগানো। আমাদের পার্টনারশিপের সময়েও ওরা খুব সক্রিয় ছিল। এমনকী আমাদের ম্যানেজার ছিলেন চেতন চৌহান। উনিও গা গরম করা একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
সেঞ্চুরি পূর্ণ করে সে দিন রাহুলের প্রেস বক্সের দিকে মারমুখী ব্যাট তোলা
দ্রাবিড়: ওটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আজ দশ বছর বাদে বলছি বিশেষ কারও দিকে ওটা দেখাইনি। সে বার প্রচণ্ড সমালোচনার মধ্যে আমি এবং আমরা পড়েছিলাম। ওটা বোধহয় একটা সংকেত ছিল যে, যাক! রিলিফ বোধ করছি। অবশেষে যে মুক্তি এল!
লক্ষ্মণ: রাহুল দারুণ ব্যাট করেছিল। আর সত্যি বলতে কী, পরিবেশটা এমন ছিল যে, আমাদের প্রতি বলে মনঃসংযোগ করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
ইডেনে কী আছে যে, ওঁদের দু’জনের সেরাটা বার হয়ে আসে
দ্রাবিড়: ফ্যানদের প্যাশন। শহরে পা দিলেই সেটা বোঝা যায়, একটা অন্য জায়গায় এসেছি। এ বার দুঃখজনক ভাবে সেটা কিছুটা কম দেখলাম। হয়তো এত বেশি ক্রিকেট হচ্ছে বলে লোকে সামান্য মুখ ফিরিয়েছে। কিন্তু কলকাতায় খেলতে এলে একটা অদ্ভুত ম্যাজিক টের পাওয়া যায়। ওই পার্টনারশিপের কথা লোকে এত বলে...তাঁদের হয়তো মনে পড়ে না, আমার প্রথম ফার্স্ট ক্লাস হান্ড্রেড ইডেনে। এ মাঠেই আমার দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি আছে পাকিস্তানের সঙ্গে। সত্যি বলতে কী, এ মাঠে কোনটা আমার সেরা ইনিংস বাছতে আমি সমস্যাতেই পড়ব।
লক্ষ্মণ: আমি ভীষণ উদ্দীপিত বোধ করি কলকাতায় এলে। পরিবেশটাই এমন যে, বাড়তি এনার্জি এনে দেয়। ভারতের অন্য অনেক মাঠেও আমার ভাল ইনিংস আছে। কিন্তু ইডেনে নামলে কিছু যেন একটা পিছন থেকে ধাক্কা মারে। তবে সেঞ্চুরির র্যাঙ্কিংয়ে আমিও বিশ্বাসী নই। সব ক’টাই সমান দামি।
এ বারে এসে অনুভূতি
দ্রাবিড়: এ বারে অত লোক হবে না শুনে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমার যেটা সবচেয়ে দুঃখ হয় কলকাতায় এসে আগে যে রকম খোলা মেজাজে ঘুরে বেড়াতাম সেটা আর নিরাপত্তার কড়াকড়িতে করতে পারি না। যুগ এত বদলে গেছে যে, অনিবার্য ভাবে নিরাপত্তা বাড়াতেই হয়েছে। অনেক প্লেয়ার তাই রুমে বসেই কাটিয়ে দেয়। অথচ আমার মনে আছে আট-দশ বছর আগে যখন ইন্ডিয়ার হয়ে খেলছি, তখনও ট্যাক্সি করে পার্ক স্ট্রিটে খেতে গেছি। আমি, অনিল আর শ্রীনাথ। কলকাতা শহরটাকে চেখেছি। আজ আর সেই উপায় নেই।
লক্ষ্মণ: আমিও শুনছি এ বার লোক কম হবে। শুধু ইন্ডিয়ার ব্যাটিং নিয়েই নাকি বেশি উৎসাহ। তা বলে ইডেনে নামলে দুর্দান্ত লাগবে না, সেটা ভাবতে রাজি নই। ইডেন আমার কাছে ইডেনই থাকবে। ভাবতেও ভাল লাগে প্রিয় এই মাঠটাতে একটা অমর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি।
সচিনের শততম সেঞ্চুরি
দ্রাবিড়: হাঁকপাক করার কিছু নেই। আমি তো বলেইছি ও বেশ ভাল খেলছে। এই সিরিজেই হয়ে যাওয়া উচিত।
লক্ষ্মণ: খুব শিগগির হবে। যেমন খেলছে, খুব স্বাভাবিক ভাবে হবে। সবাই বলছে কোটলাতে মাত্র ২৪ রানের জন্য হল না। আমি উল্টো বলছি। ও কী খেলেছে সে দিন কেউ খেয়াল করেছেন? ফিডেল এডওয়ার্ডস সে দিন সকালে যা বল করছিল, তাতে সামলানো কঠিন ছিল। সচিন কোথায় ঘাবড়াবে, উল্টে বোলিংকে শাসন করা শুরু করল। ওই রুদ্রমূর্তি দেখার পর আমি নিশ্চিত, সেঞ্চুরিটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
|
ইডেনের সেই ঐতিহাসিক টেস্ট |
লক্ষ্মণ ২৮১ |
দ্রাবিড় ১৮০ |
জুটিতে ৩৭৬ |
পঞ্চম উইকেটে ভারতের সর্বোচ্চ পার্টনারশিপ (১০৪.১ ওভারে)
(স্টিভ ওয়-র অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০০১ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে) |
|