মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরে জেলায় প্রথম পা রাখা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতে বর্ধমান শহরে মানুষ নেমে এল রাস্তায়।
রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ছিল না, দলের তরফে ‘সংগঠিত’ কর্মী-বাহিনীও নয়। দাবি-দাওয়া জানানো অসম্ভব, নিদেনপক্ষে নেত্রীর বক্তৃতা শোনারও সুযোগ নেই। রাজ্যে ‘পরিবর্তনের কাণ্ডারী’কে স্রেফ চোখের দেখা দেখতেই কার্যত ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাবে রাস্তায় নেমে এলেন বর্ধমানের মানুষ। ছাদ-বারান্দা ছাপিয়েও উপচে পড়ল ভিড়।
সেই বর্ধমান, সাত মাস আগেও যাকে সিপিএমের ‘অজেয় দুর্গ’ বলে মনে করা হত। নিরুপম সেন, মদন ঘোষ, বিনয় কোঙারদের ‘দাপটে’ বিরোধীদের প্রায় খুঁজেই পাওয়া যেত না। সেখানেই শনিবার বিকেলে ভিড়ের ঠেলায় অন্তত সাত বার থমকে গেল মমতার কনভয়। মাঝপথে নেমে তাঁকে হাঁটতে হল কিছুটা। ব্যারিকেড ভেঙে তখনও ছুটে আসার চেষ্টা করছে উৎসাহী জনতা।
মমতাকে দেখতে জনতার এই উৎসাহের কথা সিপিএম অবশ্য মানতে চায়নি। দলের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের দাবি, “মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা এই প্রথম এলেন। সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা থাকার কথা, তা কিন্তু ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে এসেছিলেন, তখন অনেক বেশি ভিড় হয়েছিল।” তৃণমূল নেতা স্বপন দেবনাথের পাল্টা প্রশ্ন, “ভিড়টা ওঁরা মাপলেন কী ভাবে।”
সকালে দুর্গাপুর থেকে মুখ্যমন্ত্রী যখন বীরভূমের দিকে রওনা দেন, তখনই পানাগড়-মোরগ্রাম সড়কের দার্জিলিং মোড়ে তাঁর গাড়ি লক্ষ করে কুচো ফুল ছোড়া শুরু হয়েছিল। ফেরার পথে তাঁকে ‘স্বাগত’ জানালেন অসংখ্য মানুষ। ইতিউতি তৃণমূলের কিছু পতাকা ছিল ঠিকই, কিন্তু তা নগণ্য।
কনভয়ে অত্যুৎসাহী জনতার হুমড়ি খেয়ে পড়া ঠেকাতে রাস্তার দু’পাশে মোতায়েন ছিল প্রচুর পুলিশ। বিজয়তোরণ থেকে প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত প্রায় আধ কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার দু’পাশে দড়ি বেঁধেও ভিড় ঠেকিয়ে রাখা হয়। মমতা মানেই মানুষের ভিড়, এটা আর এখন নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্ধমান শহরের ভিড়ের চেহারাটা তুলনায় ভিন্ন।
ভিড় যে ‘সংগঠিত’ নয়, তা পরিষ্কার সিপিএম নেতাদের কথাতেই। দলের জেলা কমিটির সদস্য অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সংগঠিত ভাবে দলের লোক আসেনি। তবে ভিড় উপচে পড়েছে, তেমনও নয়। বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু লোক হয়েছে।” অমলবাবু বলেন, “ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও ডিএম সরকারি কর্মচারীদের আসার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তাই কোর্ট চত্বরে কিছু লোক হয়েছিল।”
আর, জনতা কী বলছে? অফিসে আগে ছুটি নিয়ে মাধবডিহির ছোট বৈনান থেকে এসেছিলেন প্যাথলজিক্যাল সেন্টারের কর্মী মৌসুমি বেজ। তাঁর কথায়, “ফেরার শেষ বাস রাত ৮টা নাগাদ। মনে হচ্ছে, বাড়ি ফিরতে পারব না। তবু দিদিকে দেখা চাই-ই।” আইনজীবী মলয়চন্দন ঘোষ বিকেলেই চেম্বার বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিলেন আদালত চত্বরে। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী এত কাছে আসছেন, দেখব না?” সকালেই রায়না থেকে চলে এসেছিলেন মিলন ভট্টাচার্য। তাঁর গোঁ, “দিদিকে না দেখে যাব না বলে মুড়ি-চিঁড়ে বেঁধে এনেছি।”
পির বাহারামের প্রাইভেট টিউটর শেখ রিয়াজউদ্দিনও ছাত্রদের ছুটি দিয়ে ভিড়ে সামিল। বললেন, “অনেক দিন ধরেই ওঁকে কাছ থেকে দেখতে চেষ্টা করছিলাম। কাল ছাত্রছাত্রীদের কাছে কালকে গল্প বলব।” ক্রিকেট টুর্নামেন্ট না খেলে শহরেরই ভাঙাকুঠি থেকে এসেছিলেন দেবাঞ্জন ঘোষ। তিনি বলেন, “খেলা থাকলে আমি নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাই। কিন্তু আজ ব্যাপার আলাদা।”
প্রশাসনিক ভবনে ঢোকার একটু আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন মমতা। হাত নাড়তে নাড়তে হাঁটলেন কয়েক গজ। মুখ্যমন্ত্রী নন, কয়েক মাস আগে ঠিক যে ভাবে হাঁটতেন রাজ্যের বিরোধী নেত্রী। জনতা আওয়াজ তুলল, ‘দিদি! দিদি!’ |