নানা ‘অসুখে’ আক্রান্ত মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। হাজারও নেই-এর মধ্যে সব থেকে বড় সঙ্কট
চিকিৎসকদের না থাকা। হাজিরার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কিন্তু তার পরোয়া করেন না অধিকাংশ চিকিৎসকই। দুই মেদিনীপুরের
একমাত্র মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের হাজিরার হাল নিয়ে আনন্দবাজার-এর প্রতিবেদন। |
চাকরির শর্ত নিয়ে এতটা ছেলেখেলার নজির বোধহয় আর কোনও পেশাতেই মিলবে না, যা করছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারবাবুরা। হাজিরা নিয়ে দিনের পর দিন তাঁদের ‘তুঘলকি’ মেডিক্যালের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ নড়বড়ে বলেই সম্ভব হচ্ছে বলে অভিযোগ। আর নড়বড়ে প্রশাসনের সুযোগেই মেডিক্যাল কলেজ ঘিরে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি ও পরীক্ষাগারের মালিকরা রমরমা কারবার ফেঁদে ফেলেছেন।
হাসপাতালে এসেই বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা রোগীর রক্ত নিয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষার জন্য। হাসপাতালে ওষুধ থাকা সত্ত্বেও লেখা হচ্ছে দামি ওষুধ। বিনিময়ে ওই সব সংস্থা হাউসস্টাফ ও চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার খরচ দিচ্ছে বলে অভিযোগ। রয়েছে আরও নানা উপঢৌকনের ব্যবস্থাও। একই কারণে মেডিক্যালে কোনও রোগীর এক্সরে-র দিন পড়ছে এক-দেড় মাস পরে। ইউএসজি করতেও একই অবস্থা। কে দেখবে? কার কাছেই বা অভিযোগ জানাবেন মানুষ?
বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইস প্রিন্সিপাল তথা হাসপাতাল সুপারের পদ শূন্য। চিকিৎসক রামনারায়ণ মাইতিই অস্থায়ী ভাবে সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। স্থায়ী অধ্যক্ষের বদলির পর নতুন অধ্যক্ষও নিয়োগ হয়নি। সে ক্ষেত্রেও অস্থায়ী ভাবে কাজ চালাচ্ছেন সার্জারি-র বিভাগীয় প্রধান সুকুমার মাইতি। স্থায়ী পদে থেকে প্রশাসনিক ‘রাশ’ যত শক্ত ভাবে ধরা সম্ভব, অস্থায়ী বন্দোবস্তে সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলেই কোনও কোনও মহলের বক্তব্য। ফলে চিকিৎসকদের নিয়মিত হাজিরা সুনিশ্চিত করা কিংবা কেউ গরহাজির থাকলে লাল কালিতে দাগানো আর হয় না।
সিনিয়র ডাক্তারবাবুরা থাকেন না। হাউসস্টাফ, ইন্টার্নদের ভরসাতেই চলছে একটা আস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। তাঁদের একাংশকে ‘হাত করে’ হাসপাতালের ভিতরে অবাধ গতিবিধি বেসরকারি প্যাথলজি সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের। হাউসস্টাফদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে দামি ওষুধ যা বাজার থেকে কিনতে হবে। অথচ একই মানের কম দামেরও ওষুধ রয়েছে। তাঁদের দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে, কোন প্যাথলজি সেন্টারে রক্ত পরীক্ষা বা এক্সরে করাতে হবে। এমনকী বেসরকারি সংস্থার কর্মীরাই হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর দেহ থেকে রক্তও নিয়ে যাচ্ছেন! কেউ দেখার নেই, বলারও নেই।
২০০৪ সালের ২৫ অগস্ট মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যদিও তার আগেই কলেজে পঠন-পাঠন শুরু হয়ে গিয়েছিল। উদ্বোধনের সময় থেকে ধরলে আট বছর হয়ে গেল এই মেডিক্যাল কলেজের। মেদিনীপুর সদর হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল কলেজে উন্নীত হয়ে সামান্যই বদলেছে পরিকাঠামো। কয়েক জন নতুন চিকিৎসক অবশ্য এসেছেন। তাঁদের অনেকেই ‘বিশেষজ্ঞ’। যা আগে সদর হাসপাতালের সময়ে ছিল না। সে দিক থেকে চিকিৎসা-পরিষেবার মানোন্নয়নের কিছুটা সুযোগ অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধিকাংশের গরহাজিরার জেরে পরিষেবায় উন্নতির সুযোগ থাকছে না। মেডিক্যালের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের মনোভাব, দক্ষতা ও ক্ষমতা নিয়ে তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে।
চিকিৎসক সংগঠনগুলির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সংগঠনগুলি তাদের আওতাভুক্ত চিকিৎসকদের মধ্যে কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে উদ্যোগী হয়নি বলেই অভিযোগ। এক বার প্রকাশ্যেই তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রকে মেডিক্যাল কলেজের বৈঠক শেষে বলতে হয়েছিল, “কিছুই করার নেই। বেশি কিছু বললে চিকিৎসকেরা হাসপাতালে কাজই করবে না।” যাঁদের চাপে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও অসহায় মন্তব্য করতে হয়েছিল, তাঁরা বহাল তবিয়তেই বছরের পর বছর মেদিনীপুরেই থেকে গিয়েছেন। প্রথমে মেদিনীপুর সদর হাসপাতালে চাকরি করেছেন। পরে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। তাঁরা এতটাই প্রভাবশালী, বদলিও হন না। তাঁরা মিলেই কার্যত ‘ঘুঘুর বাসা’ তৈরি করেছেন।
চিকিৎসক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কোনও কোনও চিকিৎসকের নিজেদের প্যাথলজি সেন্টার রয়েছে। কোনও চিকিৎসকের সঙ্গে বেসরকারি নার্সিংহোমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অভিযোগ, নিজেদের স্বার্থেই তাঁরা হাসপাতালে পরিষেবা পঙ্গু রাখতে চান। চিকিৎসকদের যে অংশ এ সব কারবারের বিরুদ্ধে, তাঁদের অনেককে কিন্তু এক দিনের নোটিসেও বদলি হতে হয়। এমন নজির রয়েছে। প্রতিবাদ করার সাহসও এখন কদাচিৎ দেখা যায়।
নতুন সরকারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্য দফতর রেখেছেন নিজের হাতে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকে নিজে একাধিক হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছেন। রাজ্যের বেহাল স্বাস্থ্য-চিত্রে পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু জেলার হাসপাতালে ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙতে পারবে কি নতুন সরকার— সংশয় কিন্তু থাকছেই।
|