ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া তো আছেই।
ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়ার যৌথ উপসর্গ সৃষ্টি করা ‘অজানা’ জীবাণুঘটিত জ্বরের জন্যও মশারই বাড়বাড়ন্তকে দায়ী করেছেন পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা। ওঁদের অনুমাণের কারণ, মহানগরের যে যে অঞ্চলে ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়ার মতো মশকবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, ‘অজানা’ জ্বরের রোগীও মিলছে মূলত সেই সব জায়গাতেই।
এবং এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞেরা ধারণা, ‘অজানা’ জ্বরের জীবাণুও বহন করছে মশা। জ্বরের উপসর্গ ও চরিত্র দেখেও গবেষকদের মনে ধারণাটি দৃঢ়তর হয়েছে।
কিন্তু মশাবাহিত হোক না-হোক, যে রোগের জীবাণুকেই শনাক্ত করা গেল না, এখন তা থেকে বাঁচার উপায় কী?
কার্যত দায়িত্বটা আপাতত ‘প্রকৃতির হাতে’ই ছেড়ে দিচ্ছেন পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য: মশা নিয়ন্ত্রণ না-হওয়ায় ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়া ও ‘অজ্ঞাত’ জ্বরের হাত থেকে মহানগরীকে বাঁচাতে এখন শীতই ভরসা। কারণ, জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়লে এমনিতেই মশা কমবে। রাশ পড়বে জ্বরের প্রকোপেও।
কলকাতা পুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য ‘অজানা’ জ্বর ছড়ানোর দায় মশার উপরে চাপাতে রাজি নয়। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষের প্রশ্ন, “যে রোগের জীবাণুই ধরা পড়ল না, সেটা মশাবাহিত বলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কী করে?” তাঁর বক্তব্য, পুরসভা বছরভর মশানিধন অভিযান চালিয়েছে। শহর ও লাগোয়া তিনটি খালে সারা বছর নৌকা ও স্পিডবোট চালানো হয়েছে। তাই বরং এ বার ম্যালেরিয়া-সহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ গত বছরের তুলনায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করেন মেয়র পারিষদ।
তবে জাঁকিয়ে শীত পড়লে পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের চিন্তা যে অনেকটা কমবে, পুর-কর্তৃপক্ষও তা মেনে নিচ্ছেন। কেননা কড়া শীতে মশার উপদ্রবে ভাঁটা আসবে। ঠান্ডা ঠিক কতটা পড়লে মশারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে?
পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, জব্বর শীত হলে তো খুবই ভাল। এমনকী, তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলেই মশার বংশবৃদ্ধি ধাক্কা খাওয়ার কথা। উপরন্তু কম তাপমাত্রায় মশার শরীরে বাড়তে থাকা জীবাণুর জীবনচক্রেও পরিবর্তন আসে। তাদের সক্রিয়তা কমে যায়। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর বিশ্লেষণ: পরিমণ্ডলের তাপমাত্রা নামতে শুরু করলে মশার বংশবৃদ্ধির হারও নামে। কেননা ঠান্ডায় লার্ভা ও পিউপার বৃদ্ধি অনেকটা হ্রাস পায়। তাপমাত্রা যত নামে, তত কমে মশার বংশবৃদ্ধির হার। ফলে পরিমণ্ডলে নতুন মশার সংখ্যা কমতে থাকে। তাই শীতে মশার ঘনত্ব কমে যায়।
একই সঙ্গে কম তাপমাত্রায় বিভিন্ন পরজীবীর সক্রিয়তাও হ্রাস পায় বলে জানিয়েছেন অমিতাভবাবু। তাঁর কথায়, “মশার শরীরে বিভিন্ন পরজীবী কতটা সক্রিয় থাকবে, সেটা নির্ভর করে মশার শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা উপরে। তা কমে গেলে জীবাণুর বৃদ্ধি ভীষণই হ্রাস পায়। ফলে তারা অনেক নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। রোগ সংক্রমণের হারও কমে যায়।”
তাই শহরের জ্বরমুক্তির জন্য অমিতাভবাবুরা শীতের অপেক্ষায় রয়েছেন। যদিও শীত ‘অজানা’ জ্বরের রমরমায় দাঁড়ি টানতে পারবে কি না, তা নিয়ে সব বিশেষজ্ঞ পুরোপুরি নিশ্চিত নন। যেমন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তীর সংশয়, “ঠান্ডা পড়লে স্বাভাবিক নিয়মেই ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার সক্রিয়তা কমে যায়। কিন্তু যে জীবাণু ধরাই পড়ল না, তা কোন তাপমাত্রায় কী ব্যবহার করবে বলা মুশকিল।”
এ বার অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে উত্তুরে হাওয়া ঢুকতে শুরু করেছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা একটু একটু করে নামছে, যা এখন ১৯-২০ ডিগ্রির কাছাকাছি। এতেই প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের সক্রিয়তা অনেকটা কমে যায়। তবে মশাকে নিষ্ক্রিয় করতে এবং মশার সংখ্যা কমার জন্য তাপমাত্রা আরও একটু নামা দরকার বলে জানাচ্ছেন পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা।
১৫ ডিগ্রিতে কবে নামবে তাপমাত্রা?
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস: আগামী দু’সপ্তাহ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মোটামুটি এমনই থাকবে। তা ১৫-১৬ ডিগ্রিতে নামতে নামতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ গড়িয়ে যেতে পারে।
অতএব, জ্বরের হাত রেহাই পেতে নগরবাসীর আরও দু’-তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই! |