|
|
|
|
অসীম বিশ্বাসেই জয়ের রাজপথে |
রূপায়ণ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
মোহনবাগান-৩ (সুনীল, অসীম, জুয়েল)
চার্চিল-০ |
ওই হেডটার জন্য অস্ট্রেলিয়া আর অশোকনগর বক্সে লাফিয়েছিল একসঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ান ৬ ফিট সাড়ে ৪ ইঞ্চি লম্বা, আর আমাদের বঙ্গসন্তান কত? হবেন বড়জোর ৫ ফিট ৬।
অবাক হওয়ার পালা, তালগাছ ছাড়িয়ে অশোকনগরের অসীম বিশ্বাসই আকাশে। একটু তেরচা ছিল হেডটা। অসীমই পরে বলছিলেন, জীবনের অন্যতম সেরা স্পট জাম্প।
বিরতির এক মিনিট আগের এই দৃশ্যই বলে দিচ্ছিল, মোহনবাগানের মরিয়া মেজাজ। অসীম বিশ্বাস।
অতীত বলছে, গত দশটা যুদ্ধে চার্চিলকে মাত্র একবার হারিয়েছে মোহনবাগান।
বর্তমান জানাচ্ছে, মোহনবাগান সমর্থকদের চিৎকার, “তোরা তিন দিলে আমরাও তিন”।
‘তোরা’ মানে কারা, বলে দিতে হবে? মনে না পড়লে, আগের দিনের কাগজের স্কোর লাইন দেখলেই হয়।
সুব্রত ভট্টাচার্যর কোচিং গুরু পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সেরা সময়ে নানা তাকলাগানো চাল দিতেন। এক বার, কোরিয়ায় চিনের বিরুদ্ধে সুব্রতকেই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার নামিয়ে বাজিমাত করেছিলেন। ডুরান্ড কাপে আগে না-খেলা সুভাষ ভৌমিককে ফাইনালে হঠাৎ প্রথম দলে রাখা, ডি সি এম ফাইনালে কাজল মুখোপাধ্যায়কে শেষ দিকে নামানোরূপকথার গল্প হয়ে আছে ভারতীয় ফুটবলের স্ট্র্যাটেজিতে।
সুব্রতরও এমন এমন অদ্ভূত চাল দেওয়ার অভ্যাস। বুধবার সারা রাত তাঁর কেটেছে আসানসোলের শ্মশানে, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র অকাল প্রয়াণে। সকালে আসানসোল থেকে কলকাতা ফিরে আবার অঙ্ক। অসীমকে এখনও ফরোয়ার্ডে খেলিয়ে যাওয়া, কিংশুককে স্টপারে রাখা, বারবার রক্ষণ-মাঝমাঠ বদল, নেতা বদলএই চালগুলো তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি। পিকের স্টাইল ছেড়ে অমল দত্ত সুলভ পরীক্ষা বেশি করতে গিয়ে অতীতে ডুবেছেন সুব্রত, কিন্তু পরীক্ষা ছাড়েননি।
|
|
চার্চিল-বধের পর তৃপ্ত সুব্রত। বৃহস্পতিবার। ছবি: উৎপল সরকার |
বল তাড়া করছে। দৌড়চ্ছে। পাস করছে। শুয়ে ট্যাকল করছে। শেষ মিনিটে গোলের জন্য প্রতিআক্রমণে যাচ্ছে।
মোহনবাগান এ গুলো পারছে। তখন সুব্রতর দল বেলোয়ারি ঝাড়।
ওপেন স্পেস তৈরি। সাপোর্টিং প্লে। ফাইনাল থ্রু পাস। বিপজ্জনক ক্রস। রক্ষণ জমাট রাখা।
মোহনবাগান এ গুলো পারছে না। তখন সুব্রতর দল ভাঙা লণ্ঠন।
ফলে খেলা দেখে মনে হচ্ছে, সুব্রতর ফুটবলাররা অ্যাটাকিং থার্ডটাই এখনও ভাল করে চেনেন না। সারা ম্যাচে গোল তিনটে বাদে তারা সিটার তৈরি করল মাত্র দুটো। ভারতীয় ফুটবলের নতুন টিডি রব বান পি এস ভি আইন্দোভেনে রোনাল্ডোকে সাড়ে তিন বছর দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ম্যাচটা দেখে গোলমুখে ভারতীয়দের ব্যর্থতাই চোখে পড়ল বেশি। প্রশংসা করলেন অসীমের হেডের।
প্রেস বক্সে সারাক্ষণ হাজির এক মেঘমন্দ্র গলা এবং তার মালিক চিমা ওকোরি। সঙ্গে ওডাফা। শেষ দিকে মোহনবাগানের নাজেহাল রক্ষণ দেখে চিমা আফসোস করতে পারেন, এই প্রজন্মে কেন আমি খেললাম না? এই সময়টা মোহনবাগানের গতিও ধাঁ করে সাউথ সিটি মল থেকে পাড়ার দোকান হয়ে গেল। বারপোস্ট বাঁচাল একবার। মরিয়া মেজাজ তো দুর্বল রক্ষণ ঢাকতে পারে না।
দেশের একমাত্র পারিবারিক ক্লাব চার্চিলে ৫৭ জন ফুটবলার এ বার। গোয়া লিগের জন্য আলাদা টিম, আলাদা কোচ। আই লিগের জন্য আলাদা। বাজেট ১১ কোটিডেম্পো, সালগাওকরের থেকে বেশি। ভাল মানের বিদেশি আনার ব্যাপারে গত পনেরো বছরে চার্চিলই সবার আগে। অস্ট্রেলিয়ান স্টপার অ্যান্টুন কোভাচিচকে এনে তাদের রক্ষণের অবয়বটাই পাল্টে গিয়েছে। গৌরমাঙ্গি এবং অ্যান্টুন দুয়ে মিলে দেশের সেরা স্টপার লাইন। কিন্তু মোহনবাগানের প্রথম দুটো গোলেই অ্যান্টুনের পা এবং মাথা। অসীমের ২-০র গোলটা শুরুতেই বলা আছে। সুনীলের ১-০র সময় শটটা অ্যান্টুনের পায়ে লেগে, গতি বদলে ঢুকে গেল গোলে।
সুনীলের নড়াচড়ায় আবার বাসা বেঁধেছে আত্মবিশ্বাস। ভারতের এক নম্বর স্টপার গৌরমাঙ্গিকে প্রতিপক্ষে দেখে এক নম্বর স্ট্রাইকার বেশ তেতেছিলেন। কিন্তু মাঝমাঠ থেকে বলই পেলেন না তো! ব্যারেটো, স্নেহাশিস নামার পরেও না। দু’জনেই এখনও খেলার জায়গায় আসেননি। সুরকুমারও না। শেষ মিনিটে প্রতি আক্রমণে জুয়েলকে দিয়ে গোলটা করালেও ব্যারেটোর গতি বাড়াতে সমস্যা হচ্ছে। স্নেহাশিসকে ১৩ মিনিটের বেশি রাখাই গেল না মাঠে।
সুব্রতর ভাগ্য ভাল, ‘লেফট-রাইট, লেফট-রাইট’ বলে প্যারেড করার ফুটবলার তাঁর হাতে। রহিম নবি। লেফট হাফ, রাইট হাফ, লেফট ব্যাক, রাইট ব্যাকযেখানে খেলাও কমিটমেন্টে নবি একশোতে একশো। জো পল আনচেরির পরে এত ভাল ইউটিলিটি ফুটবলার ভারতে আসেননি। নবিকে দ্বিতীয়ার্ধে রক্ষণে নামানোর পরেই জেল্লা শেষ মোহন মাঝমাঠের। সেখানে তখন ঝলমলে আই লিগের অন্যতম আবিষ্কার দুই মিডফিল্ডার, মালয়ালি তরুণ জাকির মুন্ডামপারা ও গোয়ান তরুণ লেনি। নবি এতক্ষণ এঁদের চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। এই লোককে রক্ষণে রাখা মানে আক্রমণ নষ্ট করা।
এই সময় বোঝা যাচ্ছিল, চার্চিল কেন আই লিগে হারেনি এ বার। বোঝা যাচ্ছিল, চার্চিলের পর্তুগিজ কোচ ম্যানুয়েল গোমস কেন বেটোকেই ছাড়াই অকুতোভয়। ম্যানুয়েলের মাঝমাঠের সঙ্গে সুব্রতর মাঝমাঠে পাল্লা দিলেন শুধু বজবজের জুয়েল রাজা। ম্যাচের সেরা হাদসনকে বড়জোর মন্ত্রী বলা যায়, কিন্তু দিনের রাজা জুয়েলই। কিংশুক দেবনাথ, জুয়েল রাজা, রহিম নবি, অসীম বিশ্বাসএই বাঙালি নামগুলো রাতজাগা ক্লান্ত সুব্রতর উজ্জ্বল উদ্ধার।
ভুল লেখা হল। উজ্জ্বল উদ্ধার, চার্চিলের বিরুদ্ধে জয়ের রাজপথ চেনা। মোহনবাগান ৩: চার্চিল ০শেষ কবে ওই স্কোর দেখেছে আই লিগ?
|
মোহনবাগানে খেলেন: সংগ্রাম, সুরকুমার (স্নেহাশিস, ব্যারেটো), আনোয়ার, কিংশুক, ধনরাজন, নবি, জুয়েল, রাকেশ, হাদসন (শৌভিক), সুনীল, অসীম। |
|
|
|
|
|