আটত্রিশ বছর পর বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে আইন-অমান্য আন্দোলনে অবতীর্ণ। দীর্ঘ বিরতি, সন্দেহ নাই। তবে তাহার কারণ একটিই এই আটত্রিশ বছরের মধ্যে চৌত্রিশ বছর বামেরাই এ রাজ্যে ক্ষমতাসীন ছিলেন। নিজেদের শাসন ও আইনের বিরুদ্ধে তাঁহারা কেমন করিয়াই বা আন্দোলনে নামিতেন? অন্যথায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতির প্রতিবাদে এই আন্দোলন, তাহার বিরুদ্ধে বামপন্থীরা তো কম আন্দোলন করেন নাই। তবে কিনা সেই আন্দোলন অধিকাংশতই ছিল ‘বাংলা বন্ধ’ নামক ঘরে-বসা নিশ্চেষ্টতা ও সংগ্রামবিমুখতার উচ্চারণ। এখন রাজ্যে বামেরা ক্ষমতাচ্যুত। ক্ষমতায় একটি অ-বাম সরকার, যাহার শাসকরা আবার কেন্দ্রেও সরকারের শরিক। তাই আন্দোলন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হইলেও একই সঙ্গে রাজ্যকেও আঘাত ও অচল করার আস্ফালন তাহাতে ওতপ্রোত। সম্ভবত সেই কারণেই চলতি মাসেই একেবারে তিন-তিনটি আইন-অমান্যের ডাক দিয়াছেন বামপন্থীরা। ‘আইন-অমান্য’ গাঁধীজি প্রণীত আন্দোলন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসককে ভারতবাসীর দাবি শিরোধার্য করিতে বাধ্য করিতে যাহার প্রবর্তন। বামপন্থীরা আন্দোলনের প্রকরণ নির্বাচন করিতে গিয়া গাঁধীবাদের উত্তরাধিকারই সাদরে বরণ করিয়া লইতেছেন, ইহার মধ্যে ইতিহাসের একটি সূক্ষ্ম পরিহাসও নিহিত রহিয়াছে। গাঁধীজির আইন-অমান্যে অবশ্য জবরদস্তির কোনও স্থান ছিল না। বরং অহিংসার পথ হইতে আন্দোলনকারীরা বিচ্যুত হইলে তিনি পত্রপাঠ সে-আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়া লইতেন (চৌরিচৌরার ঘটনা স্মর্তব্য)। বামপন্থীদের আইন-অমান্য স্বভাবতই তত নিরামিষ হইতে পারে না। ইহাতে জবরদস্তির, এমনকী প্রয়োজনে পুলিশের সহিত সংঘর্ষের সম্ভাবনাও মূর্ত থাকে। জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সমর্থনে অবতীর্ণ বামপন্থাও কালক্রমে জঙ্গি হইয়া উঠিতে পারে। এ ধরনের আইন-অমান্য বর্তমানে দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছেই কমবেশি গ্রাহ্য হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু অন্য রকম আইন-অমান্যের সম্ভাবনাও কি বিবেচনা করা যায় না, যাহার মধ্যে অতিরিক্ত ‘আইন-মান্যতা’র ধারণা ও ভাবনাটিও নিহিত থাকিতে পারে?
ধরা যাক, দশটা-পাঁচটায় অফিস-কাছারি করার যে আইন আছে, তাহা অমান্য করিয়া পাঁচটার পরেও করণিকরা অফিসে কাজ করিতে লাগিলেন। কিংবা আন্দোলন যখন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে, তখন কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসগুলিতে ছুটির দিনে, এমনকী প্রজাতন্ত্র দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসেও সরকারি কর্মীরা অফিসে গিয়া পুরা সময় কাজ করিলেন! ইহাও তো চলতি আইনকে অমান্য করাই কাজের সময় বাঁধিয়া দেওয়ার আইন, জাতীয় আবেগ উদ্যাপন করার জন্য সরকারি দফতরে তালা ঝুলাইবার আইন, মনীষীদের (গাঁধী হইতে আম্বেডকর) জন্মদিন কিংবা ধর্মীয় পরব (জন্মাষ্টমী, ইদ-মহরম, ক্রিস্টমাস) পালন করার অজুহাতে অফিসে না গিয়া সবেতন ছুটি উপভোগের আইন। অমান্য করিতে হইলে এই সব আইনও তো অমান্য করা যায়। অমান্য করা উচিত। আইন-অমান্য মানে কেবল কাজকর্ম বন্ধ করা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বানচাল করা, অফিসে গরহাজির থাকা কিংবা সেখানকার চেয়ার-টেবিল লণ্ডভণ্ড করা, পুলিশকে লক্ষ করিয়া ইটপাটকেল ছোঁড়া কিংবা রাস্তার দুই ধারের দোকানপাট, পার্ক-করা গাড়িতে ভাঙচুর চালানো বুঝাইবে কেন? আটত্রিশ বছর পর বঙ্গীয় বামপন্থীরা যখন নূতন করিয়া আইন-অমান্য আন্দোলনের স্বর্ণযুগ আনিতে উদ্যত, তখন সেই আন্দোলনের নূতন ভাষাই বা খুঁজিয়া লইবেন না কেন? সেটাই, সেই ‘আইন-মান্যতা’র ইতিবাচক আন্দোলনই তো হইতে পারে প্রকৃত আইন-অমান্য! তাহাতে আর কিছু না হউক, অন্তত একটি উন্নততর বামফ্রন্টের ছায়া খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। |