|
|
|
|
বিনোদন ১ |
জনতার আবেগের সঙ্গে মিশল আভিজাত্য গৌতম চক্রবর্তী • কলকাতা |
|
|
পরিবর্তন, অবশ্যই! ১৯৯৫ সালের ১০ নভেম্বর, তখনকার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উৎসাহে যে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছিল, ১৭তম বছরে তার মেজাজে তুমুল পরিবর্তন ঘটে গেল!
পরিবর্তন এক: এত দিন উদ্বোধন হত নন্দনে নির্দিষ্ট কিছু আমন্ত্রিত দর্শকদের সামনে। বেশির ভাগই চেনা মুখ। ফলে মুখ্যমন্ত্রী ও দর্শক সকলেই অলিখিত এক প্রোটোকলে আবদ্ধ থাকতেন। মুখ্যমন্ত্রী ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সকলে নীরবে চেয়ার ছেড়ে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াতেন। আর এ বার? আবেগের বিস্ফোরণ! জিৎ, দেব প্রমুখ নায়ক ঢুকছেন, নেতাজি ইন্ডোরে জনতার উল্লাস। শাহরুখের জন্য তো কান পাতা দায়! কিন্তু সব থেকে বেশি চিৎকার এ দিন যেন তাঁর জন্যই বরাদ্দ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন এ বার আর শুধু আমন্ত্রিত দর্শকের জন্য নয়। দশ টাকার টিকিট কেটে যে কেউ ঢুকতে পারেন। আর সেই দশ টাকার টিকিট তো ওলন্দাজ সিনেমা নয়, মমতা এবং শাহরুখ খানকেই দেখতে চায়! উৎসব এ বার চেনামুখের গণ্ডি ছাপিয়ে আমজনতার।
এই আমজনতার জন্যই তো শাহরুখ খানের মতো মেগা-তারকাকে নিয়ে এসেছেন তিনি। মঞ্চে ওঠার আগে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্টেডিয়ামের এ দিক-ও দিক। পরে একটা সময়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে শাহরুখকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করছেন। শাহরুখও তাঁকে ডাকছেন ‘দিদি’ বলে।
আর, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আভিজাত্য? শাহরুখের সঙ্গেই মঞ্চে উঠলেন তিনি। লাল ব্লাউজ আর ঘি রঙের শাড়ির ওপরে ময়ূরকণ্ঠী, সবুজ আঁচল। স্বামী টাইগার পটৌডির মৃত্যুর পর শর্মিলা ঠাকুরের এ দিনই প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। তা-ও আবার বাপের বাড়ির শহরে। তাঁর ছেলেবেলা, পটৌডির সঙ্গে প্রথম দেখা ইত্যাদি স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন ‘নায়ক’-এর নায়িকা। এই উৎসবেই দেখানো হবে সত্যজিতের সেই ছবি। আভিজাত্য আর আমজনতা সকলের চাহিদা পূরণ হল এ ভাবেই। এর আগে আন্তোনিয়নি, জানুসি, মণিরত্নম অনেকেই উৎসব উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু আমজনতা ও আভিজাত্যের এই মিশেল আসেনি। এখানেই পরিবর্তন নম্বর দুই। |
|
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শর্মিলা ঠাকুর ও
শাহরুখ খানের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: অশোক মজুমদার |
তিন নম্বর পরিবর্তন, আমরা-ওরার বিভাজন রেখাটাকে আরও ক্ষীণ করে দেওয়া। যার শুরু মমতার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই। বুধবার ফিল্ম উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিজে ফোন করে একটা নজির স্থাপন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন অনুষ্ঠানের দর্শক আসনে বুদ্ধ-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন অপর্ণা সেন,প্রথম পাতার পর
সুমন মুখোপাধ্যায়রা। ছিলেন শঙ্খ ঘোষও। মৃণাল সেন আসতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এ দিনই উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান রঞ্জিত মল্লিককে ফোন করে ‘অসাধারণ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের’ জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের স্থিরচিত্রের প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে আজ নন্দনে যাবেন তিনি। উল্লেখ্য, নন্দীগ্রাম পর্বের পরে শঙ্খ-অপর্ণা-সুমনরা চলচ্চিত্রোৎসব বয়কট করলেও মৃণাল-সুনীল করেননি।
এত দিন মঞ্চে থাকত আমলা ও নেতাদের ভিড়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকতেন মুখ্যসচিব, প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি, তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব, নন্দন-অধিকর্তা। থাকতেন কলকাতার মেয়র। এ বার আমলা ও নেতাদের সেই ভিড় নেই। মঞ্চে প্রসেনজিৎ, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। অন্য দিকে দর্শক আসনে জিৎ, দেবের পাশাপাশি শ্রাবন্তী, লকেট, দুই প্রযোজক মণি ও শ্রীকান্ত। রয়েছেন আলোকচিত্রী, সম্পাদক, শব্দযন্ত্রী ও অন্য কলাকুশলীরাও। আগে আমন্ত্রণ না পেলে অনেক কলাকুশলীকেই ৩০০ টাকার ‘ডেলিগেট কার্ড’ করাতে হত। এ বার উৎসব কমিটি কলাকুশলীদের জন্য ৬০০ কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিল। টলিউডের বিপুল উপস্থিতিতেই নিহিত থেকে গেল পরিবর্তন নম্বর চার। তাই বলে পাড়ার জলসার অব্যবস্থা কিন্তু গ্রাস করেনি এ দিনের অনুষ্ঠানকে। বরং সুচারু হয়ে ওঠার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে শর্মিলা ঠাকুরেরও। যিনি অনুষ্ঠান শেষে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, “কোচি, গোয়া নানা জায়গায় যাই। কিন্তু এখানকার ব্যবস্থাপনা সত্যিই নজরকাড়া।” |
|
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে নেতাজি ইন্ডোরের বাইরে দর্শকদের ভিড়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
এত দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বলতে ছিল মূলত বক্তৃতা। আর নন্দনের সিঁড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে হলুদ শাড়িতে, খোঁপায় ফুল গুঁজে মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান। এ বার বক্তৃতার বহর কম। নাচে মমতাশঙ্কর। তার আগে আব্রাহাম মজুমদারের অর্কেস্ট্রা। কোয়েল মল্লিক থালি গার্ল হয়ে আলো বয়ে আনলেন। গত তিন-চার বছর ‘থালি গার্ল’ ছিল না। কান, বার্লিনের আদলে তুলে দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ নম্বরে থেকে গেল মেজাজের এই পরিবর্তন।
আর ছয় নম্বর পরিবর্তন? আগের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বলে দিতেন, কোন কোন দেশ থেকে ক’টি ছবি আছে। ভাল ছবি কোনগুলি। জানুসি, কিয়েস্লস্কি থেকে মণিরত্নম ছিল তাঁর ঠোঁটস্থ। কৌতূহল ছিল, এ বারের মুখ্যমন্ত্রী কী বলবেন? সিনেমাবোধে তিনি কি আদৌ পাল্লা দিতে পারবেন তাঁর পূর্বসূরির সঙ্গে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই রাস্তাতেই হাঁটলেন না। গদার, নুরি বিজ সিয়েলান, আব্বাস কিয়েরোস্তামির ছবি এ বারের উৎসবেই আছে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সে সব বললেনই না। বরং কলকাতায় ফিল্ম সিটি হবে, পশ্চিমবঙ্গ আবার শিল্পে-সাহিত্যে সেরা হবে ইত্যাদি সাদামাঠা কথা। রবীন্দ্রনাথকেও উদ্ধৃত করলেন, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো।’ রবীন্দ্রনাথ, সাদামাঠা কথা, জনতার আবেগ ছুঁয়ে যাওয়া, শাহরুখ থেকে সকলের ‘দিদি’ হয়ে ওঠা... এটাই তো তাঁর স্টাইল!
এই একটা জায়গায় পরিবর্তন হয়নি। মমতা আছেন মমতাতেই! |
|
|
|
|
|