কাসভের ফাঁসি চাইল পাকিস্তান
গিলানিকে শান্তিকামী বলে ভিত গড়ার পথে
দেড় বছর আগে ভুটানে যে আলোচনার পথ খুলেছিলেন, আজ মলদ্বীপে তাকেই আরও জোরদার করলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
মলদ্বীপের রাজধানী মালেতে এ দিন সার্ক সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেন মনমোহন সিংহ এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। সেই বৈঠকে কাশ্মীর-সহ যাবতীয় বিতর্কিত বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়। যে আলোচনার শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীই বললেন, ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে দুই দেশ। বৈঠকের পরে ২৬/১১-এর একমাত্র জীবিত জঙ্গি আজমল কাসভ সম্পর্কে প্রকাশ্যেই কঠোর অবস্থান ঘোষণা করল ইসলামাবাদ। পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, “কাসভ এক জন সন্ত্রাসবাদী। তার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও সম্পর্ক নেই। সে ‘নন স্টেট অ্যাক্টর’। অবশ্যই তাকে ফাঁসি দেওয়া উচিত।” এই স্বীকারোক্তিতে অবশ্যই খুশি নয়াদিল্লি। পাক পদক্ষেপকে স্বাগত জানাতে আজ শীর্ষ বৈঠকের পর গিলানিকে ‘শান্তিকামী’ (ম্যান অফ পিস) বলে অ্যাখ্যাও দিয়েছেন মনমোহন।
ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, শুধু কাসভ সম্পর্কে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়াই নয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসলামাবাদের তরফ থেকে এমন কিছু কূটনৈতিক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘ইতিবাচক গতি’ দিতে সক্ষম। আজকের শীর্ষ বৈঠকে মুম্বই হামলায় অভিযুক্ত পাকিস্তানের আদালতে বিচারাধীন ব্যক্তিদের মামলাও যাতে দ্রুত শেষ করা যায়, সে ব্যাপারে সদিচ্ছা দেখিয়েছে ইসলামাবাদ। রেহমান জানিয়েছেন, পাকিস্তানের বিচারবিভাগীয় কমিটি তাদের আসন্ন ভারত সফর শেষ করার পর যে তথ্য নিয়ে দেশে ফিরবে, তার দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে রয়েছেন তাঁরা। কারণ তাদের সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে দ্রুত ওই মামলার ‘সন্তোষজনক’ নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। এই পরিস্থিতিতে তাই সাউথ ব্লকের দাবি, থিম্পু থেকে মালে, দেড় বছর ধরে লাগাতার কূটনৈতিক প্রয়াসের ফল মিলছে অবশেষে।
বৈঠকের পর মনমোহন-গিলানি। রয়েছেন পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারও। ছবি: পি টি আই
২৬/১১-র পরে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক যখন অত্যন্ত সঙ্কটের মধ্যে, সেই সময় মনমোহন সিংহ বুঝেছিলেন আলোচনা প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব কতটা। পরে বারবার তিনি জানিয়েছেন, আলোচনা বন্ধ করে দিলে সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাতে আখেরে লাভ হয় না। সে কারণেই মিশরের শর্ম অল শেখে নির্জোট সম্মেলনের মঞ্চে তিনি প্রথম বরফ গলানোর চেষ্টা করেন। তার পরে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে সার্কের বৈঠকে নতুন করে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। এর পরে দেড় বছরে পারস্পরিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যেও বিভিন্ন স্তরে আলোচনা শুরু করা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি তারই ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে দিল্লির বক্তব্য।
যদিও এত ‘ইতিবাচকের’ মধ্যে কিছু ‘বেসুর’-ও শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের গলায়। যেমন, পাক জঙ্গি সংগঠন ‘জামাত-উদ-দাওয়া’ সম্পর্কে ভারতের অভিযোগ কার্যত খারিজ করে দিয়েছে ইসলামাবাদ। তাদের বক্তব্য, এই সংগঠন যে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত, তার কোনও প্রমাণ পাকিস্তানের হাতে নেই। তাই জামাত-উদ-দাওয়াকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে গিলানি প্রশাসন। সে এই নিয়ে যতই প্রতিবাদ করুক নয়াদিল্লি। দ্বিতীয়ত, কাসভের ফাঁসির প্রসঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণের অভিযুক্তদেরও ফাঁসির দাবি তুলেছে গিলানি সরকার (নয়াদিল্লির দীর্ঘ দিনের বক্তব্য, তাদের দিকে কোনও ভাবে আঙুল উঠলে বরাবরই পাকিস্তান এই ভাবে পাল্টা অভিযোগ খাড়া করে)।
কিন্তু ভারত-পাক জটিল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই ‘বেসুর’-কে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ সাউথ ব্লক। বরং প্রধানমন্ত্রী বললেন, পারস্পরিক দোষারোপের সময়কে দুই দেশ পিছনে ফেলে এসেছে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দিকটি মাথায় রেখেই কিন্তু ভারতকে শান্তি প্রক্রিয়ায় এগোতে হবে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং মোল্লাতন্ত্র, ক্ষমতার সব ক’টি ভরকেন্দ্রই যথেষ্ট ক্ষমতাবান। নেতৃত্বের প্রশ্নে পাকিস্তান যে বহুধা বিভক্ত, সে কথা নয়াদিল্লির কূটনৈতিক মহলে বহু বারই আলোচনা হয়েছে (এক সময় দিল্লির প্রশ্ন ছিল, তা হলে কার সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালাব?)। নয়াদিল্লি তাই ভাল ভাবেই জানে, তাদের সঙ্গে মসৃণ ভাবে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা পাক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে কতটা কঠিন। কিন্তু কট্টরবাদী অংশটিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ারও পক্ষপাতী নন মনমোহন। তাঁর বক্তব্য, তা হলে দর কষাকষির কোনও পথই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
আর তাই আজকের বৈঠকে সন্ত্রাস ও বাণিজ্য, দুই আপাত পরস্পর-বিরোধী বিষয় নিয়ে যে সব ইতিবাচক প্রাপ্তি হয়েছে, সেগুলিকে সঙ্গে নিয়েই সামনের দিকে হাঁটতে চাইছে মনমোহন সরকার। যেখান থেকে মনমোহন বলেছেন, এখন পর্যন্ত যা অগ্রগতি তাতে তাঁরা খুশি। এবং আশা করেছেন, পরের বৈঠকগুলি আরও কার্যকরী হওয়া উচিত।
প্রাপ্তিগুলি কী? ২৬/১১-র পর থেকে ভারত ধারাবাহিক ভাবে দাবি করে আসছে, অভিযুক্তদের অবিলম্বে শাস্তি দেওয়া হোক। ধৃত আজমল কাসভকে নিয়েও চলেছে দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েন। পাশাপাশি পাকিস্তান যাতে ভারতকে বাণিজ্যে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের (এমএফএন) মর্যাদা দেয়, সে জন্যও ক্লান্তিহীন ভাবে দরবার করা হয়েছে। আজকের বৈঠকে এই ক্ষেত্রগুলিতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছে। তার পর স্বাভাবিক ভাবেই পাক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে দরাজ হয়েছেন মনমোহন। তাঁর কথায়, “আমি বরাবরই মনে করি গিলানি শান্তিকামী। তাঁর সঙ্গে প্রত্যেকটি বৈঠকের পর এই বিশ্বাসই আমার দৃঢ় হয়েছে। আমাদের কথাবার্তার ফল ফলতে শুরু করেছে।...গিলানির সঙ্গে আমি একমত যে, এর পরের পর্যায়ের আলোচনা আরও বেশি ফলাফল-কেন্দ্রিক হওয়া প্রয়োজন।” দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও উদার করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকের পরে তাই বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই বলেন, “পাকিস্তান জানিয়েছে যে তারা আমাদের দ্রুত এমএফএন-এর মর্যাদা দেবে। তেমনই আমরাও স্থির করেছি, পাকিস্তানের সঙ্গে অগ্রাধিকারভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তির (প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট) দিকে এগোবো।” আগামী ১৪ নভেম্বর দু’দেশের বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিশদে কথা হবে বলে জানিয়েছেন মাথাই।
প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে গিলানি বলেছেন, “ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অত্যন্ত খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। স্যার ক্রিক, সিয়াচেন, কাশ্মীর এবং সন্ত্রাসবাদ সব ক’টি বিষয় নিয়েই আমাদের কথা হয়েছে। এর পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনা ভারত-পাক সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করতে চলেছে।” সূত্রের খবর, বৈঠকে মনমোহনকে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য একাধিক বার অনুরোধ করেছেন গিলানি। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত শীঘ্রই পাক সরকারকে জানাবেন।
স্থির হয়েছে খুব শীঘ্রই, দু’দেশের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা আলোচনায় বসবেন। দু’দেশের মধ্যে ভিসা প্রোটোকল খুব দ্রুত স্বাক্ষর হবে। শিথিল করা হবে ভিসা ব্যবস্থা। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, পাকিস্তানে একাধিক শক্তিকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু লাদেন-হত্যার পরে পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম। আমেরিকা-সহ গোটা আন্তর্জাতিক মহল পাকিস্তানকে কাঠগড়ায় তুলেছে। এখন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা তাদের কাছে খুবই জরুরি। অন্য দিকে, মনমোহন সরকারও দেশে মূল্যবৃদ্ধি থেকে দুর্নীতি, বিভিন্ন বিষয়ে নাজেহাল। তারাও তাই ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করতে উৎসাহী। সব মিলিয়ে তাই মালেতে মৈত্রীর সুর জোরদার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.