সিগারেটের নেশা ছাড়ানোর দাওয়াই! তা-ও আবার এক ধরনের সিগারেট!
সেই ‘ইলেকট্রনিক সিগারেট’ বা ‘ই-সিগারেট’ এসে গেল ভারতের বাজারেও। একই সঙ্গে উঠেছে প্রশ্ন, এর ব্যবহার কতটা নিরাপদ?
ই-সিগারেট দেখতে অবিকল যেন আসল সিগারেট। তাতে রয়েছে একাধিক চেম্বার। একটা চেম্বারে নিকোটিনের দ্রবণ, যাকে গরম করে তোলে অন্য চেম্বারে থাকা একটি ব্যাটারি। ব্যাটারি থেকে নির্গত বিদ্যুৎ-তরঙ্গের স্পর্শে নিকোটিন-দ্রবণ ফুটতে শুরু করে। যে ধোঁয়া বেরোয়, তা নিকোটিনের গন্ধে ভরপুর। ওই ধোঁয়া মুখে ভরে ফের নাক-মুখ দিয়ে ছেড়ে দিলেই হল। মুখে ভুরভুর করবে তামাকের ঘ্রাণ!
আসল সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে এর ফারাকটা তা হলে কোথায়?
আসল সিগারেট পুড়লে ধোঁয়ার সঙ্গে যে হাইড্রোকার্বন ও রাসায়নিক মেশে, তা অতীব বিপজ্জনক। এমনকী, তা থেকে ক্যানসারও হতে পারে। উপরন্তু আসল সিগারেটের কাগজ-পোড়া ধোঁয়াও (মূলত কার্বন মনোক্সাইড) ফুসফুসের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু ই-সিগারেটে সামান্য নিকোটিন (যা সহনমাত্রার মধ্যে) ছাড়া স্বাস্থ্যহানিকর কোনও রাসায়নিক তৈরি হয় না বলেই প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর দাবি।
যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিস্তর মামলা-মোকদ্দমার পরে মার্কিন মুলুক ও ইউরোপে ই-সিগারেটের চল বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় অনুমোদন ছাড়া দিল্লি-মুম্বইয়ের বাজারেও বিকোচ্ছে। কিন্তু এ দেশের ক্যানসার-চিকিৎসকদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, নিকোটিনের ধোঁয়া শরীরে ঢোকা কতটা নিরাপদ?
যেমন, ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় ই-সিগারেটকে দরাজ সার্টিফিকেট দিতে নারাজ। তাঁর যুক্তি, “নিকোটিনে যথেষ্ট নেশা হয়। ডাক্তার হিসেবে আমি একটা নেশা ছাড়াতে আর একটা নেশা ধরানোয় সায় দিতে পারি না।” ধূমপান বিরোধী একটি সর্বভারতীয় সংগঠনের তরফে সোমা রায়চৌধুরীর বক্তব্য, “সিগারেট ছাড়াতে নিকোটিনের চুইংগাম, নিকোটিন-প্যাচ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। মনে হয়, ই-সিগারেট এগুলোর মতোই কাজ করবে। তবে দেখতে হবে, এতে কতটা নিকোটিন শরীরে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত নিকোটিন গেলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি ১% হলেও থাকে।”
আর তাই যথাযথ গবেষণার পরেই ই-সিগারেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সোমাদেবীরা। চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক পার্থ বসু অবশ্য বলছেন, “রাতারাতি একটা নেশা ছাড়া কঠিন। তাই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কিছুটা নিকোটিন শরীরে ঢুকিয়ে নেশা ছাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু ডাক্তারেরা অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, মনের জোর না-থাকলে কোনও যন্ত্রেই নেশা যাবে না।”
অন্য দিকে ইতালির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গবেষকের দাবি: ই-সিগারেটে ধূমপানের নেশা অনেকটাই কাটে। এঁদের বক্তব্য: ৪০ জন অনর্গল ধূমপায়ীর (চেন স্মোকার) উপরে পরীক্ষা চালিয়ে এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। দেখা গিয়েছে, ই-সিগারেট ব্যবহারের ছ’মাস পরে ২০ জন দৈনিক সিগারেটের সংখ্যা অর্ধেক করে ফেলেছেন। ১০ জন ধূমপান একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। ওই গবেষকদের দাবি, আরও বেশি দিন ই-সিগারেট ব্যবহার করলে ধূমপান সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
তবু ইউরোপ-আমেরিকায় ই-সিগারেটকে আইনি লড়াই জিতে বাজারে আসতে হয়েছে। আমেরিকান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর বক্তব্য ছিল: মানুষের উপরে লাগাতার পরীক্ষা না-করে এটি বিক্রি হওয়া উচিত নয়, কারণ, এই যন্ত্র মানুষকে নিকোটিনের নেশা ধরিয়ে দিতে পারে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাকশন অন স্মোকিং অ্যান্ড হেল্থের মতো সংগঠন এফডিএ-র পিছনে দাঁড়ালেও আদালতে তাদের দাবি টেকেনি।
এবং আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের সমীক্ষা বলছে, এক বছরে গোটা মার্কিন মুলুকে ই-সিগারেটের ব্যবহার ঊর্ধ্বমুখী। ৩০ লক্ষ মানুষ সিগারেট ছেড়ে ই-সিগারেট ব্যবহার করছেন। ব্রিটিশ মেডিক্যাল সোসাইটিও ই-সিগারেটকে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ হিসেবে অভিহিত করে জানিয়েছে, এটি কয়েক লক্ষ মানুষের জীবনহানির শঙ্কা দূর করেছে। তা সত্ত্বেও এফডিএ ই-সিগারেটের বিরুদ্ধে প্রচারে ক্ষান্ত দেয়নি।
এই দাবি-পাল্টা দাবি-প্রশ্ন-বিতর্কের মাঝে ভারত সরকারের কী অবস্থান? কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর: কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগের একাংশ মনে করছে, ই-সিগারেট বিক্রির অনুমোদন দেওয়ার আগে সব দিক যাচাই করা হোক। এবং ক্ষতিকর কিছু পাওয়া না-গেলে তা ‘ওষুধ’ হিসেবে বিক্রির অনুমতি দেওয়া হোক। নিছক ভোগ্যপণ্য হিসেবে নয়। |