কয়েক মাস আগে অনিল বসুর যা হয়েছিল, এ বার সেই পরিণতি হল বিমান বসুর!
সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে মেজাজ হারিয়ে বুধবার তাঁর একটি মন্তব্য ‘শালীনতার সীমা’ ছাড়ানোয় এবং দলের ভিতরে-বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় বিবৃতি দিয়ে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করতে হল বিমানবাবুকে। টিভি চ্যানেলের দৌলতে তাঁর ওই মন্তব্য অবশ্য তত ক্ষণে সর্বত্র প্রচারিত। বিমানবাবু দুঃখপ্রকাশ করলেও তাঁর এবং তাঁর দলের ভাবমূর্তির যা ক্ষতি হওয়ার, তত ক্ষণে হয়ে গিয়েছে।
তবে বিমানবাবু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক, পলিটব্যুরো সদস্য এবং বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান হওয়ায় তাঁর ‘দুঃখপ্রকাশ’ বাম রাজনীতিতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। রাজ্য কমিটির সদস্য হলেও সিপিএমে অনিলবাবু মূলত জেলার নেতা। তাই বিধানসভা ভোটের আগে তাঁর মন্তব্যের জন্য তাঁকে দিয়ে দলের ‘দুঃখপ্রকাশে’র চেয়ে বিমানবাবুর ঘটনাটি আরও ‘গুরুতর’ বলেই বাম মহলের ব্যাখ্যা।
পেট্রো-পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত কি না, এই রাজনৈতিক প্রশ্নে মেজাজ হারান বিমানবাবু। তার জেরে ‘অশালীন’ মন্তব্য করে বসেন। ফলে যে বিষয়টি ছিল একান্তই কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে টানাপোড়েন, সেখানে কোনও ভাবে জড়িত না-হয়েও বামফ্রন্টের ‘ভাবমূর্তি’ জনমানসে ক্ষতিগ্রস্ত হল!
কেন্দ্রীয় সরকারকে মমতার হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রথমে কোনও মতামত দিতে চাইছিলেন না বিমানবাবু। আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্টের বৈঠক শেষে সাংবাদিক বৈঠকে ওই বিষয়ে বারেবারেই সে কথা বলেনও তিনি। কিন্তু সাংবাদিক বৈঠক শেষ করে উঠে যাওয়ার মুখে খানিকটা ‘অপ্রত্যাশিত’ ভাবেই হাতের বিচিত্র মুদ্রা সহযোগে তিনি বলে বসেন, “কংগ্রেস আর তৃণমূল, কে শাড়ির নীচে থাকবে, কে উপরে থাকবে, আমি কী করে বলব!” আনুষ্ঠানিক ভাবে সাংবাদিক বৈঠকে ওই মন্তব্য না-করলেও বিমানবাবু টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে যেতে ওই কথা বলায় তা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ‘রেকর্ড’ হয়ে যায়। শাসক শিবিরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ‘অস্বস্তি’ বাড়ে বিমানবাবুর এবং সামগ্রিক ভাবে সিপিএম তথা গোটা বামফ্রন্টের।
সন্ধ্যায় বিমানবাবু লিখিত বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আমার একটি মন্তব্য আমার নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। সাংবাদিক সম্মেলনে বারংবার একই প্রশ্নে আমি সাময়িক ভাবে বিরক্ত হই। বিরক্ত হওয়া আমার ঠিক হয়নি। বিরক্ত হয়ে যে কথা বলেছি, তা ওই ভাবে বলা ঠিক হয়নি’।
আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর, বিমানবাবুর মন্তব্য নিয়ে টিভি-তে তোলপাড় হচ্ছে দেখে সন্ধ্যায় রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েক জন বর্ষীয়ান সদস্য তাঁর সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় বসেন। বিমানবাবুকে বোঝান, ওই মন্তব্যের জেরে বামেদের সম্পর্কেই সামগ্রিক ভাবে ‘ভুল বার্তা’ গিয়েছে। বিমানবাবু বলেন, তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে কে কার উপর ‘আধিপত্য’ করবে, সে ব্যাপারে তাঁদের যে কিছু বলার নেই এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। ‘অন্য কোনও অর্থে’ কিছু বলেননি। তার পর ফ্রন্ট চেয়ারম্যান হিসাবে বিবৃতি দিয়ে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেন। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “দল এবং ফ্রন্ট হিসাবে বামেরা অনেক সচেতন বলেই বিমানবাবু বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায় সে অর্থে কোনও অশ্লীল বা অসংসদীয় শব্দ ছিল না। তবুও ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার সুযোগ ছিল। ভুল হয়ে থাকলে তা সংশোধনে কমিউনিস্টদের কুণ্ঠা থাকা উচিত নয়। এ নিয়ে আর জলঘোলাও অর্থহীন।”
বিধানসভা ভোটের আগে কলকাতা প্রেস ক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’-এ এক প্রশ্নের জবাবে কোথায় কোথায় ‘পরিবর্তন’ হয়েছে, তা বোঝাতে গিয়ে বিমানবাবু পশ্চাদ্দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বাঁকুড়ার এক জনসভাতেও ‘পাবলিক’ সম্পর্কে তিনি একটি বিশেষণ প্রয়োগ করেছিলেন। যা আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ব্যবহার করা যায় না। তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল। তখন অবশ্য বিমানবাবু বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেননি! তাঁর এ দিনের মেজাজ হারানো এবং ‘অসংযত’ মন্তব্যে প্রমাণিত, ভোটে মানুষের কাছে ‘প্রত্যাখ্যাত’ হয়েও তাঁরা স্বভাব ‘পরিবর্তন’ করতে পারেননি। বাম মহলের একাংশের ধারনা, বিমানবাবু পরে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করলেও জনমানসে এই ‘বার্তা’ই গেল যে, তাঁরা কিছুই শেখেননি!
বিমানবাবুর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় বলেন, “অশ্লীল শব্দের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য হয় না। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। সিপিএম এমন মন্তব্য করতেই অভ্যস্ত। এর আগে আমরা বিনয় কোঙার, অনিল বসু, শ্যামল চক্রবর্তীদের এই রকম মন্তব্য করতে দেখেছি।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “বিমানবাবুর মন্তব্য শুধু অশালীনই নয়, সভ্যতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে। বাংলার রাজনীতিতে একটা বড় সাংস্কৃতিক চেতনা ছিল সভ্যতা ও শোভনীয়তা রক্ষা করে কথা বলা। সেই সংস্কৃতিকে বিমানবাবুরা ধূলিসাৎ করছেন!” এক ধাপ এগিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া দাবি করেন, “ক্ষমতা হারিয়ে বিমানবাবুদের এখন পাগলা দাশুর মতো অবস্থা! ওঁর উচিত মেট্রো চ্যানেলে চাঁদোয়া খাটিয়ে ৫ মিনিট ধরে ক্ষমা চাওয়া!” সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের বক্তব্যে ‘কমিউনিস্ট সংস্কৃতি’ই ধরা পড়েছে বলেও মন্তব্য মানসবাবুর। রাজ্য সম্পাদকের কথায় সব কমিউনিস্টেরই বদনাম হচ্ছে জানিয়ে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ দাবি করেছেন, সিপিএমের উচিত বিমানবাবুকে ‘ভর্ৎসনা’ করা।
বিমানবাবু এ দিন কিন্তু শুরু করেছিলেন শান্ত ভাবেই। ফের পেট্রো-পণ্যের দাম বাড়লে সমর্থন তোলার যে হুঁশিয়ারি মমতা দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে তিনি প্রথমে বলেন, “ওঁরা ইউপিএ-র শরিক। ওঁরা কী করবেন, টেবিলে বসে আলোচনা করে সমস্যা মেটাবেন কি না, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।” তৃণমূলের সমর্থন তোলা উচিত কি না, সে প্রশ্নের জবাবেও বলেন, “ইউপিএ শরিকদের বামফ্রন্ট ঔচিত্যের পাঠ দিতে যাবে না!” কিন্তু মেজাজ হারান এর পরেই। পরে বিবৃতিতে বিমানবাবু বলেন, ‘নির্দিষ্ট শব্দপ্রয়োগ অন্য কোনও অর্থ বহন করতে পারে, তাৎক্ষণিক ভাবে এ কথা আমার মনে হয়নি। তবু এ ভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। এ কারণে আমি দুঃখপ্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে আমি আরও যত্নবান থাকব’। |