বালককে পিষে মারা হাতির মাহুতকে ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দিল বর্ধমান আদালত। কিন্তু হাতিটিকে পুলিশ আটক করেনি। মাহুতের সঙ্গী সেটিকে নিয়ে হুগলির আরামবাগের দিকে চলে গিয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। বন দফতরের নিষেধ থাকলেও নানা শহরে-গ্রামে যে রকম হাতি দেখিয়ে, তার পিঠে বাচ্চাদের চড়িয়ে পয়সা নেওয়া হয়, উত্তরপ্রদেশ থেকে তেমনই এসেছিল ‘আনারকলি’ নামে এই হস্তিনীটি। মঙ্গলবার দুপুরে বর্ধমান শহরের আনজির বাগানে হঠাৎই সেটি বিবেক সাহনি নামে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে ফেলে পিষে দেয়। পরে পুলিশ পাহারায় মাহুত হাতিটিকে সরিয়ে নিয়ে যান। অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগে রাতে মাহুত অনিল ওরফে মগরু দুবেকে গ্রেফতার করা হয়।
দুর্ঘটনার পরেই হাতির হেফাজত নিয়ে পুলিশ ও বন দফতরের চাপান-উতোর শুরু হয়েছিল। পুলিশের অভিযোগ, হাতিটিকে রাখার ব্যাপারে বন দফতরের সাহায্য চাওয়া হলেও বর্ধমানের বিভাগীয় বনাধিকারিক গোপালচন্দ্র কাজুরি জানিয়ে দেন, পোষা হাতির হেফাজত তাঁদের কাজ নয়। যদিও পরে রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল অতনু রাহা জানান, পুলিশ সাহায্য চেয়ে থাকলে বনকর্মীদের এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। |
জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরের বক্তব্য, “বন দফতর সাহায্য না করাতেই আমরা হাতিটিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। কেননা কী ভাবে হাতির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, তা আমাদের জানা নেই।” মঙ্গলবারই রাজ্যের বনকর্তারা জানিয়েছিলেন, এ রকম ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার ক্ষেত্রে বন দফতরের পরামর্শ নিয়ে হাতিটিকে কোনও চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেওয়া উচিত পুলিশের। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও যথাযথ সহযোগিতা মেলেনি বলে বর্ধমান থানার দাবি।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, হাতিটির শারীরিক অবস্থা কেমন? কী কারণে, কী পরিস্থিতিতে সেটি পয়সা দিতে বালককে আক্রমণ করেছিল? তাকে নিয়ে লোকালয়ে ঘুরে বেড়ানো আদৌ ঠিক কি না? জেলার এক বনকর্তার মতে, দুর্ঘটনার পরেই পশু চিকিৎসক ও বনকর্মীদের পাঠিয়ে হাতিটির শারীরিক অবস্থা ও মেজাজমর্জি পরীক্ষা করা উচিত ছিল। হাতিটিকে রাখার ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করাও জরুরি ছিল। তা হলে হাতিটি অন্তত লোকালয়ে ঘুরত না। কিন্তু মঙ্গলবারের মতো এ দিনও বহু চেষ্টাতেও বিভাগীয় বনাধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার পরে মাহুতের সঙ্গী দারোগাদাস মিশ্র হাতিটিকে নিয়ে আরামবাগের দিকে হাঁটা দিয়েছেন। প্রথমে বারাণসীর কথা বললেও পরে বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি জানিয়েছেন, টাকা রোজগারের জন্য তাঁরা উত্তরপ্রদেশের সীতামারি আশ্রম থেকে ‘লিজ’-এ হাতিটিকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হাতির মালিকের নাম জানা যায়নি। |
তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হাতিটি সম্ভবত অসুস্থ বা ‘পাগল’ হয়ে যায়নি। বরং ঘটনার সময়ে সে খুবই ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত ছিল বলেই অনেকের মনে হয়েছে। দুর্ঘটনার আগে আলমগঞ্জে তাকে নর্দমায় শুঁড় ডুবিয়ে জলের খোঁজ করতেও দেখা গিয়েছিল। পরে তাকে শান্ত করতে কলাগাছ-ডালপালা খেতে দেন মাহুত ও তাঁর সঙ্গী। শুঁড় বাড়িয়ে রাস্তার ধারে পাঁচিলের বাইরে বেরিয়ে থাকা গাছপালা টেনে খেতেও দেখা যায় আনারকলিকে। দুর্ঘটনার আগে কিছু ছেলে লেজ মুচড়ে, ঢিল মেরে হাতিটিকে বিরক্ত করছিল বলে মাহুত অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা হাতিটিকে পরিমাণ মতো খাবার ও জল দেননি বলে এখন এলাকাবাসী পাল্টা অভিযোগ তুলছেন।
ছেলের মৃত্যু সত্ত্বেও যিনি হাতিকে আক্রমণ করা থেকে ক্ষিপ্ত জনতাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই দিলীপ সাহনিও এ দিন ঘটনার জন্য মাহুতকে দায়ী করেছেন। আনারকলি বিবেককে শুঁড়ে পেঁচিয়ে পায়ের নীচে এনে ফেলতেই মাহুত লাফিয়ে নেমে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরে বর্ধমান থানায় দিলীপবাবু অভিযোগ করেন, মাহুতের সামনেই হাতিটি তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। সে কারণে মাহুতের যেন সাজা হয়। আনজির বাগানের মাটিবাগ পাড়ার বাড়িতে এ দিনও বারবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন তাঁর স্ত্রী মুন্নি। প্রতিবেশীরা তাঁকে আগলে রেখেছেন। ভাইয়ের ছবি বুকে চেপে ধরে কেঁদে চলেছে বিবেকের দাদা, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ঋত্বিকও। তাদের স্কুল, মুন্সি প্রেমচন্দ হিন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ দিন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দিলীপবাবুদের পড়শি পুনম সাউ, চন্দ্রশেখর সিংহেরা বলেন, “ওরা খুবই গরিব। তার উপরে এমন একটা আঘাত! প্রশাসনের তরফে ওদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা উচিত।” এ দিন স্থানীয় কাউন্সিলর খোকন দাসের সঙ্গে দেখা করে দিলীপবাবুও একই দাবি জানান। যদিও বুধবার রাত পর্যন্ত জেলা জেলা প্রশাসনের তরফে কেউ তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। তবে খোকনবাবুর আশ্বাস, “আমি নিজে মহকুমাশাসকের সঙ্গে দেখা করে ওঁদের ক্ষতিপূরণের আবেদন জানাব।”
এ দিন সকালেই মাহুত অনিল দুবেকে বর্ধমানের সিজেএম আদালতে হাজির করায় পুলিশ। তবে ৩০৪ ধারায় ‘অনিচ্ছাকৃত খুন’ ছাড়া হাতি নিয়ে ব্যবসা বা অন্য কোনও মামলা দেওয়া হয়নি। কোনও আইনজীবীও তাঁর হয়ে দাঁড়াননি। আপাতত জেল হাজতে রেখে ২২ নভেম্বর তাঁকে ফের আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। |