ভবানীপুরে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানে গোলমালের জন্য কার্যত ওই থানার পুলিশকেই দায়ী করলেন পুলিশকর্তারা। রবিবার রাতে পুলিশ কর্মীরা ‘অতি-সক্রিয়’ না হলে এই ঘটনা এড়ানো যেত বলে তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়েছে লালবাজারে। পাশাপাশিই, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে যাওয়ার ফলে ‘বড় গোলমাল’ এড়ানো গিয়েছে বলে বুধবার জানিয়েছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
রবিবার রাতে ভাসানকে কেন্দ্র করে ভবানীপুর এলাকায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ হয়। গাড়ি ভাঙচুর হয়। হামলা হয় ভবানীপুর থানাতেও। পুলিশ লাঠি চালায়। তাতে আহত হন পথচারীরা। রাতেই খবর পেয়ে বাড়ি থেকে হেঁটে ঘটনাস্থলে যান মমতা। তাঁর থানায় যাওয়া নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়। মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে অবশ্য বলা হয়, গোলমাল থামাতেই মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে যান। ঘটনাচক্রে, যিনি ওই এলাকার বিধায়কও বটে। মমতার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। অন্যান্য বড় ঘটনার মতো এই নিয়েও প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ। ঘটনার সময়ে থানার দুই সাব-ইন্সপেক্টর ও এক কনস্টেবলের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন পদস্থ পুলিশ কর্তারা।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘটনাস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে রাজ্যপাল বুধবার চেন্নাইতে বলেন, “মাঝে মধ্যে পুজো নিয়ে এমন গোলমাল ঘটে। গোলমাল চলতে থাকলে পুলিশকে আরও কড়া ব্যবস্থা নিতে হত। মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা ছিল, গোলমাল আরও বাড়বে। তাই তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন।” সংবাদসংস্থা জানাচ্ছে, রাজ্যপাল আরও মন্তব্য করেছেন, “সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি অন্য রকম ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে।”
বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী মমতার থানায় যাওয়া নিয়ে বিরোধী সিপিএম এবং বিজেপি সমালোচনা শুরু করে। এমনও অভিযোগ করা হয় যে, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের উপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী দুই আটক ব্যক্তিকে থানা থেকে ‘ছাড়িয়ে’ নিয়ে গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের তরফে অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওই তল্লাটের বাসিন্দাদের একাংশেরও বক্তব্য, মমতা কখনওই থানার ভিতরে ঢোকেননি। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়নি। ঘটনার পরের দিন ইদুজ্জোহা থাকায় কোনও ‘অপ্রীতিকর ঘটনা’ এড়াতে মমতা থানার সিঁড়িতে একটি চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে খালি গলাতেই উত্তেজিত জনতাকে শান্ত হতে বলেন। সিপি পৌঁছানোর আগেই মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। ঘটনাস্থলে হাজির রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেন, “দিদি (মমতা) কাউকে ধরতেও বলেননি। ছেড়ে দিতেও বলেননি। উনি পরিস্থিতি শান্তি করতে গিয়েছিলেন। সেটা হয়ে যাওয়ার পরেই উনি চলে যান।” মন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “তখনই দিদিকে লোকে বলছিল, পুলিশ মদ খেয়েছে! কিন্তু উনি সকলকে থামিয়ে বলেন, কোনও অবস্থাতে কেউ আইন হাতে তুলে না-নেয়। দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এ দিন রাতেই ওই ঘটনায় জড়িত জগন্নাথ সাউকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। জগন্নাথ এলাকার এক পরিচিত ‘দাদা’র অনুগামী। যিনি গত পুরসভা ভোটেও জোড়া-পাতা প্রতীক নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তিনি আবার কংগ্রেসের এক নেত্রীর ‘ছত্রছায়া’য় রয়েছেন বলে এলাকার সকলেই জানেন।
এর মধ্যেই অবশ্য পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে বলা হয়, সে দিন পুলিশকর্মীরা ‘অতি-সক্রিয়’ হয়েছিল। কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (দক্ষিণ) তাপস বসু তাঁর রিপোর্টে অতি-সক্রিয়তার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা হল
• শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশের চড়া স্বরে কথা বলা উচিত হয়নি।
• উত্তেজিত জনতাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শান্ত করা উচিত ছিল।
• জনতার উপরে লাঠি চালানো ঠিক হয়নি।
রিপোর্টে কয়েক জন অফিসারের ‘আচরণ’ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁরা ওই সময়ে ‘নেশাগ্রস্ত’ ছিলেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে, থানার ওসি এবং অতিরিক্ত ওসি-র উচিত ছিল শোভাযাত্রাকে আগাগোড়া ‘এসকর্ট’ করা (পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া)। কিন্তু তা করা হয়নি। ‘এসকর্ট’ করা হলে ঘটনা এত দূর গড়াত না।
পুলিশ কর্তাদের কাছে জমা পড়া ওই রিপোর্ট নিয়েই ক্ষোভ দানা বেঁধেছে পুলিশের একাংশের মধ্যে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ভবানীপুর থানার পুলিশ কর্মীরা জানিয়েছেন, চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের সামনে উচ্চ শব্দের বাজি (কার্যত বোমা) ফাটিয়ে এবং রাস্তা আটকে ভাসানের শোভাযাত্রা যাচ্ছিল। সেই শোভাযাত্রা না আটকে উপায় ছিল না। আর তার পরেই জনতা থানায় হামলা চালায়। পুলিশের একটা বড় অংশের মতে, মুখ্যমন্ত্রীকে ‘তুষ্ট’ করতেই লালবাজারের উঁচুতলার কর্তারা সাউথ ডিভিশনের এক এসি-কে দিয়ে এই রিপোর্ট লিখিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, ঘটনার রাতেই ডিসি (সাউথ) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ থানার অফিসারদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, রাত ন’টার কিছু পরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের সামনে উচ্চ শব্দের বাজি ফাটানো হচ্ছে খবর এসেছিল। অতিরিক্ত ওসি সেখানে পৌঁছন। ইতিমধ্যে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল থেকে থানায় ফোন করে বলা হয়, জোরে মাইক বাজিয়ে এবং বোমা ফাটিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা যাচ্ছে। পুলিশ ব্যবস্থা নিক। ওসি কয়েক জন কনস্টেবল এবং এএসআই-কে নিয়ে ওই হাসপাতালের দিকে রওনা হন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কিছু ক্ষণ পরেই অতিরিক্ত ওসি-ও মোটরসাইকেলে চেপে ঘটনাস্থলে পৌঁছন। তত ক্ষণে শোভাযাত্রা থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই হামলায় অভিযুক্ত জগন্নাথ জড়িত ছিল। তার নেতৃত্বেই পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বাধে। মার খান মমতার পাড়ার কিছু নিরপরাধ তরুণ, যাঁরা শোভাযাত্রায় ব্যান্ড বাজাতে গিয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারের তরফেই মমতাকে খবর দেওয়া হয়।
পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধের সময় শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া কয়েক জন মহিলা থানার সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। এর পরে উত্তেজিত জনতা থানার একটি মোটরসাইকেল লাথি মেরে উল্টে দেয়। ভাঙচুর করে একটি পুলিশ জিপের কাচ। থানার এক সার্জেন্ট ইটে জখম হন।
থানার পুলিশের দাবি, এই পরিস্থিতিতেই তারা প্রথমে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যায়। কটূক্তিরত মহিলাদের সরে যেতে বলা হয়। কিন্তু মহিলারা পুলিশকে লক্ষ করে থুতু ছেটান বলে অভিযোগ। ওসি এবং অতিরিক্ত ওসি-র উপর হামলা হচ্ছে দেখে পুলিশ লাঠি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। মুখ্যমন্ত্রী থানায় পৌঁছনোর সময়েও ওসি-কে মারধর করা হচ্ছিল বলেও থানার পুলিশ ডিসি (সাউথ)-কে জানিয়েছে।
তবে পুলিশের একাংশের প্রশ্ন, যদি ধরেও নেওয়া হয়, ভবানীপুর থানার পুলিশ শোভাযাত্রাকে ‘এসকর্ট’ করেনি, তা হলে যে থানা এলাকা থেকে ওই শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল, সেই কালীঘাট থানার বিরুদ্ধে ‘এসকর্ট’ না-করার কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হল না কেন। নিয়ম অনুযায়ী কালীঘাট থানা ‘এসকর্ট’ করে শোভাযাত্রাকে তার এলাকা পার করাবে। এবং পাশের থানা ভবানীপুরকে বার্তা দেবে, শোভাযাত্রা তার এলাকায় প্রবেশ করছে। কালীঘাট থানা সে বার্তা দেয়নি। লালবাজারের পুলিশ কর্তাদের একাংশ এই প্রশ্নও তুলছেন, শোভাযাত্রায় ‘ডিস্ক জকি’-র গান নিষিদ্ধ জেনেও কালীঘাট থানা থেকে ‘ডিস্ক জকি’ সমেত কেন শোভাযাত্রা বার করা হয়েছিল? রিপোর্টে সে প্রশ্ন তোলা হয়নি। |