|
|
|
|
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব |
আমন্ত্রণের সৌজন্য,
বুদ্ধদেবকে ফোন মমতার নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
|
চলচ্চিত্র উৎসবকে ঘিরেই এক সময়ে তোলপাড় তুলেছিল ‘আমরা-ওরা’র রাজনীতি। চার বছর পরে সেই চলচ্চিত্র উৎসবেই ‘সৌজন্যে’র মোক্ষম চালে ‘আমরা-ওরা’ কাত।
বুধবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সটান ফোন করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। উদ্দেশ্য খুব সহজ আজ, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো।
ঘটনাচক্রে, মহাকরণ এবং পাম অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে এই সংক্ষিপ্ত ফোনালাপ হল এমন একটা সময়ে, যখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক বৈঠকে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু মমতা এবং কংগ্রেসের রাজনৈতিক সম্পর্ক সংক্রান্ত প্রশ্নে অঙ্গভঙ্গিসহ ‘অশোভন’ মন্তব্য করে বিতর্ক বাধাচ্ছেন!
তাঁর ‘সাধের’ চলচ্চিত্র উৎসবে এ বার বুদ্ধবাবুর কোনও ভূমিকা নেই। থাকার কথাও নয়। তিনি এখন নিছকই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিনি যে সংস্কৃতির অঙ্গনে বা চলচ্চিত্র উৎসবের মতো আবহে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, এটা সর্বজনবিদিত। রাজনীতির ‘সূক্ষ্ম’ চাল দিয়ে ‘বুদ্ধ-বিহীন’ প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব থেকে তাই তাঁকে দূরে রাখতে চাননি আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। উৎসবে আসার আমন্ত্রণ জানাতে এদিন দুপুরে ‘বর্তমান’ স্বয়ং ফোন করেন ‘প্রাক্তন’কে। বলেন, আজ, বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান-সহ বাকি দিনগুলিতে বুদ্ধবাবু যদি ছবি দেখতে আসেন, তা হলে তিনি খুব খুশি হবেন।
বুদ্ধবাবু অবশ্য সেই ‘আতিথ্যের আহ্বান’ কার্যত স্বীকার করেননি। বরং ‘ব্যস্ততার’ জন্য আসতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা তবু হাল ছাড়েননি। বুদ্ধদেববাবু নিজে আসতে না পারলেও তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা যাতে আসেন, সেই অনুরোধ জানিয়ে তাঁদের জন্য আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেন। মমতা যে চলচ্চিত্র উৎসবের প্রস্তুতির শেষ রাতে এমন একটা ‘ওস্তাদের মার’ দেবেন, তা তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলও জানত না। যেমন জানাতে চাননি বুদ্ধবাবুও। দুপুরে মমতার সঙ্গে তাঁর যে ফোনে কথাবার্তা হয়েছে, সন্ধ্যায় আলিমুদ্দিনে বিমানবাবুর ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য নিয়ে ঘরোয়া আলোচনার সময়েও উপস্থিত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের তা জানাননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বুদ্ধবাবুর দলীয় সতীর্থরাও ‘খবর’টা জানতে পেরেছেন সংবাদমাধ্যম থেকেই। ফোন নিয়ে মমতাও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। বিষয়টি জানা যায় তাঁর সচিবালয় সূত্রেই।
তবে সঙ্গত কারণেই মমতার ওই উদ্যোগের সরাসরি বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটেননি তাঁরা। সম্ভবত তা সম্ভব নয় বলেই। বিশেষত, টাটকা বিমান-কাণ্ডের অব্যবহিত পরে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি তথা রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “এটা ভাল হয়েছে। খুব ভাল উদ্যোগ। তবে এই সৌজন্য সর্বত্রই প্রসারিত হওয়া উচিত।” একই সঙ্গে সেলিমের বক্তব্য, “চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে তো রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিতও নয়।” অর্থাৎ ঘুরিয়ে সিপিএম এ কথাও বলছে যে, মমতা আসলে ‘রাজনীতি’ করেছেন। যে ভাবনাকে উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হচ্ছে, মমতা ফের প্রমাণ করলেন, তিনি সঙ্কীণর্র্ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে জানেন। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্রকে তিনি কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়ান না।
বছর তিনেক আগে, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ কথা হয়েছিল বুদ্ধ-মমতার। সিঙ্গুর-আলোচনা কেন্দ্র করে রাজভবন এবং কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে দু’বার সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর মুখোমুখি হয়েছিলেন মমতা। তার পরে বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আর কেউ কারও মুখদর্শন করেননি। মমতার নাম মুখে আনতে যে তাঁর ‘রুচিতে বাধে’, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে প্রকাশ্যে এমন মন্তব্যও করেছিলেন বুদ্ধবাবু। পাল্টা তাঁর সম্পর্কে বিবিধ কটু কথা মমতার দলের নেতারাও বলেছেন। |
|
আজ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন। চলছে তারই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
বুধবার, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি: অশোক মজুমদার |
কিন্তু ভোটে জেতার পরে সৌজন্যের নজির গড়ে মমতা তাঁর দলের শীর্ষনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বুদ্ধবাবুর বাড়িতে পাঠান শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে। ঘটনার ‘আকস্মিকতায়’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যে খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, তা পার্থবাবুই পরে জানিয়েছিলেন। সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করা নিয়ে সিপিএমের অন্দরে আলোচনাও হয়। শেষ পর্যন্ত ‘পাল্টা সৌজন্য’ দেখিয়ে বুদ্ধ-বিমানরা রাজভবনে হাজির থাকারই সিদ্ধান্ত নেন। শপথের দিন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছেই সামনের সারিতে বসে-থাকা বুদ্ধবাবুর সামনে
মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করেছিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। দৃশ্যতই বিহ্বল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ঠিকমতো প্রতি-নমস্কারটাও করে উঠতে পারেননি। তবে অনুষ্ঠানের পর চা-চক্রে না থাকলেও শপথ গ্রহণের পুরো সময়টাই ছিলেন।
তার পরেও দু’তরফে ‘রাজনৈতিক লড়াই’ জারি আছে। জেলা সফরে বুদ্ধবাবু যেমন তৃণমূল তথা মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারকে লাগাতার আক্রমণ করেছেন, তেমনই মমতাও নিয়ম করে সাবেক বুদ্ধ-সরকারের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে সরব হচ্ছেন। সেই আবহে সরাসরি নিজেই বুদ্ধবাবুকে ফোন করে মমতা যে রাজ্য রাজনীতিতে আবার আলোড়ন তৈরি করলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তৃণমূলের নেতাদের ব্যাখ্যায়, চলচ্চিত্র উৎসবে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন মমতার সৌজন্যের রাজনীতিকেই আরও প্রসারিত করল।
নন্দীগ্রামের ঘটনার পরেই ২০০৭-এর চলচ্চিত্র উৎসবকে কেন্দ্র করে ‘আমরা-ওরা’র রাজনীতি প্রথম সামনে আসে। সংস্কৃতি এবং চলচ্চিত্র জগতের একটি বড় অংশ ওই উৎসবের বাইরে থেকে যান। ঘটনাচক্রে যাঁরা নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনার সরব প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমেছিলেন। তার পর থেকেই বাংলার সংস্কৃতি জগৎ দু’টি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই বিভাজনকে কমিয়ে আনতে সচেতন চেষ্টা শুরু করেন। পুরনো সরকারের বিভিন্ন কমিটির বিশিষ্ট জনেদের বর্তমান সরকারের কমিটিগুলিতে রাখার তৎপরতা বা বিভিন্ন বিষয়ে সর্বদল বৈঠক ডেকে বিরোধীদের মতামত নেওয়া তার অন্যতম। যদিও সব ক্ষেত্রে তিনি ‘সফল’ হননি। বিতর্কও রয়ে গিয়েছে। বিরোধীরা তাঁর দিকে আঙুলও তুলেছেন। তবু তাঁর বার্তাটি ছিল স্পষ্ট।
চলচ্চিত্র উৎসবের ক্ষেত্রেও মমতা সেই পথেই হেঁটেছেন। আমরা-ওরার ধারণাকে নস্যাৎ করে আগেই মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। উৎসবের আমন্ত্রণপত্রে ছাপা ‘কোলাজে’ এঁদের ছবিও আছে। মহাকরণের খবর, উৎসবের শেষের দিকে মৃণালবাবুর আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
বুদ্ধবাবুর নন্দনের চৌহদ্দি থেকে বার করে নেতাজি ইন্ডোরে উৎসবের উদ্বোধন করে, শাহরুখ খান এবং শর্মিলা ঠাকুরের মতো মূল স্রোতের তারকাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চলচ্চিত্র উৎসবকে ইতিমধ্যেই ‘জনতার উৎসব’ করে ফেলেছেন ‘জনতার মুখ্যমন্ত্রী’। কিন্তু তাঁর ‘মাস্টারস্ট্রোক’ সম্ভবত তিনি তুলে রেখেছিলেন শেষ পাতের জন্য! |
|
|
|
|
|