দীর্ঘ ৩৮ বছর পরে আবার আইন অমান্যের রাস্তায় ফিরল সিপিএম! বাম এবং অ-বাম কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে মঙ্গলবার আইন অমান্যে সামিল হল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন পুলিশ-প্রশাসনকে ‘নিজেদের’ মনে করে আইন অমান্যের কর্মসূচি নেয়নি দুই কমিউনিস্ট পার্টিই (সিপিএম এবং সিপিআই)। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতি এবং শ্রমিকদের উপরে আক্রমণের প্রতিবাদে এ দিন দেশ জুড়ে বিজেপি-র সংগঠন বিএমএস ও কংগ্রেসের আইএনটিইউসি-র হাত ধরে রাজ্যে কমিউনিস্টদের দীর্ঘ ‘বিরতি’তে ছেদ পড়ল!
রাজ্য সিপিএমের ‘পরিসংখ্যানবিদ’ নেতা রবীন দেব এ দিন রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে আইন অমান্য কর্মসূচি উপলক্ষে জমায়েতের মঞ্চ থেকেই জানিয়েছেন, এর আগে পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের দল শেষ বার এই ধরনের আন্দোলনে সামিল হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ২৮ জুন। জ্যোতি বসু, প্রশান্ত শূরের মতো অধুনা প্রয়াত নেতারা সে বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার পরে সিপিএমের কোনও গণসংগঠনের তরফেও আনুষ্ঠানিক ভাবে আইন অমান্যের কর্মসূচি এই প্রথম। এই মাসেই কৃষক সভার তরফে মহকুমা ও জেলা স্তরে আইন অমান্য করা হবে। রাজ্য বামফ্রন্টেরও এক দিন কেন্দ্রীয় ভাবে আইন অমান্য কর্মসূচি পালন করার কথা। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়নকে সামনে রেখে যে রাস্তায় সিপিএম ফিরল, সেই পথে আপাতত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। |
মোট ৭টি ইউনিয়ন মিলিত ভাবে কলকাতায় এ দিনের কর্মসূচিতে সামিল হয়েছিল। রানি রাসমণিতে জমায়েত হয়েছিল ভালই। হাতে চোট নিয়েও গ্রেফতার হয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠতে দেখা যায় সিটুর রাজ্য সভাপতি তথা প্রবীণ সাংসদ শ্যামল চক্রবর্তীকে। ‘প্রতীকী’ হলেও আইন অমান্যকারীদের সঙ্গে গ্রেফতার হয়ে বাসে ওঠেন রমলা চক্রবর্তী, অমিতাভ নন্দী, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, সুজন চক্রবর্তীর মতো নেতারা, যাঁদের শাসক শিবিরের ‘দাপুটে’ নেতা হিসাবেই মানুষ দীর্ঘ কাল দেখে এসেছেন! ট্রেড ইউনিয়নের কর্মসূচির প্রতি ‘সহমর্মিতা’ দেখাতে এবং আন্দোলনকারীদের উৎসাহ দিতে রানি রাসমণিতে এ দিন উপস্থিত ছিলেন বিমান বসু, মঞ্জুকুমার মজুমদার, মনোজ ভট্টাচার্য, দেবাশিস দত্ত-সহ বামফ্রন্টের বিভিন্ন শরিক নেতৃত্ব। বামফ্রন্টের শাসন কালে ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি অবশ্য আইন অমান্য কর্মসূচি পালন করেছিল। মঞ্জুবাবুরা এ দিনও ‘আক্ষেপ’ করেছেন, সরকারে থাকার কারণ দেখিয়ে বামফ্রন্ট আন্দোলনের পথ থেকে সরে না-এলেই ভাল করত। আন্দোলনের রাস্তায় থাকলে যে মানুষের সাড়া পাওয়া যায়, এ দিনই তার ইঙ্গিত মিলেছে বলে তাঁদের মত। পুলিশের হিসাবে, রানি রাসমণি থেকে গ্রেফতার হয়েছেন ২৮৫ জন মহিলা-সহ ৩১৬২ জন। আর ফিয়ার্স লেনের মুখে এআইসিসিটিইউ-এর পৃথক কর্মসূচিতে ২৫২ এবং এআইইউটিইউসি-র আইন অমান্যে ৪৭৭ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
রাজ্যের মধ্যে মালদহে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে জেলাশাসকের দফতরে ঢোকার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ। পুলিশ লাঠি চালালে ৮ জনের মাথা ফাটে, জখম হন আরও অন্তত ৫০ জন। আন্দোলনকারীদের হামলায় এক জন ডিএসপি, এক আইসি-সহ ৬ জন পুলিশও জখম হয়েছেন। দেশ জুড়ে ‘জেল ভরো’ কর্মসূচির সাফল্যে ‘উৎসাহিত’ ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতৃত্ব আগামী ২৫ নভেম্বর বৈঠকে বসছেন, যেখান থেকে সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটের দিনক্ষণ স্থির হতে পারে। বিজেপি-র ট্রেড ইউনিয়ন বিএমএস-ও ওই ধর্মঘটে যোগ দেবে বলে জানিয়ে রেখেছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বৈজনাথ রাই। আইএনটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভাপতি তথা কংগ্রেস সাংসদ জি সঞ্জীব রেড্ডি দাবি করেন, ‘আম আদমি’র পাশে দাঁড়ানোর যে নীতি কংগ্রেস ঘোষণা করেছে, তিনি সেই পথেই হাঁটছেন। কিন্তু মনমোহন সিংহের সরকার সেই পথে হাঁটছে না। তাঁর অভিযোগ, সরকার চলছে আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাঙ্কের বলে দেওয়া রাস্তা ধরে।
কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে এই জোট ধরে রাখতে এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্ত দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিটে ‘জেল ভরো’ আন্দোলনের মঞ্চ থেকে ‘বন্দেমাতরম, ভারত মাতা কি জয়’ বলে স্লোগান দিয়েছেন। সিটুর সাধারণ সম্পাদক তপন সেন জানান, দেশ জুড়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলির অন্তত ২৫ লক্ষ কর্মী-সমর্থক এ দিন গ্রেফতার ‘বরণ’ করেছেন।
দেশজোড়া কর্মসূচির দাবিগুলি ব্যাখ্যা করে কলকাতায় সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবু বলেন, “দ্রব্যমূল্য এবং দূর্নীতি দিন দিন বাড়ছে। শ্রমিকদের উপরে আক্রমণ হচ্ছে। ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ী করা হচ্ছে না। অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে না।” তবে সর্বভারতীয় স্তরের এই কর্মসূচির দাবিগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ‘সন্ত্রাসে’র প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বামফ্রন্টের ভিতরে-বাইরে বিতর্কের জেরে সিটু নেতারা এ দিন আর ওই বিষয়ে বিশেষ কথা বলেননি।
সিটু পশ্চিমবঙ্গে ‘সন্ত্রাসে’র প্রসঙ্গ আইন অমান্যের কর্মসূচির মধ্যে ঢুকিয়েছে, এই কারণ দেখিয়েই এ রাজ্যে ওই আন্দোলন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরে দাঁড়িয়েছিল আইএনটিইউসি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আইএনটিইউসি-র অন্দরের বিভাজন এ দিন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। রমেন পাণ্ডের নেতৃত্বে সংগঠনের একাংশ পতাকা নিয়েই রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের মঞ্চে যোগ দেন, গ্রেফতারও হন। রমেন বলেন, “আমরা সরকারে আছি, সরকারকে পূর্ণ সমর্থন করি। কিন্তু সিটুর আন্দোলনে যোগ দেওয়া উচিত নয় বলে দাবি করছেন, তাঁদের বলতে চাই, সরকার শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কাজ করলে আমরা শ্রমিকদের পাশে থাকব।”
রমেনের এই বক্তব্যকে অবশ্য ‘গুরুত্ব’ দিতে চাননি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা আইএনটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তবে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের সামনে থেকে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার পর্যন্ত আইএনটিইউসি-র ‘আনুষ্ঠানিক’ মিছিলের শেষে সমাবেশে প্রদীপবাবু বলেন, “শ্রমিকদের রক্ষা করতে হবে সরকারকে। দরকার হলে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।” |