পনেরো হাজারের চুড়োয় সচিন, কোটলায় আজ প্রার্থনা আরও ৬৭
ক্রিকেট মাঠে কুকুর ঢুকে পড়া যথেষ্ট স্বাভাবিক। দিনের নায়ককে চুমু খেতে উদ্যত তরুণীর অভাবিত ঢুকে পড়ার ঘটনাও একাধিক রয়েছে। বিদেশের মাঠে তো এই ভয়ানক নিরাপত্তা-কবলিত সমাজেও স্ট্রিকার-এর প্রবেশ থামানো যাচ্ছে না।
তা বলে টেস্টে হাড্ডাহাড্ডি দিনের খেলা শেষ হওয়া মাত্র লাটাই দিয়ে ঘুড়ি উড়বে প্যাভিলিয়নের সামনে! কখনও কোথাও দেখিনি। সোমবারের কোটলায় যা উড়ল। এখনও উড়ছে। আর ফ্লাডলাইট-স্নাত কোটলায় তার রংটা তিন তলার প্রেসবক্সে বসেও এত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বেগুনি।
খামোখা লাটাই কেন? বেগুনি রংই বা কেন বাছা হল ঈশ্বর জানেন। বিশেষ কোনও আশার প্রতীক বলে তো মনে হচ্ছে না। আশার রং তো সোনালি হলুদ। যা সূর্যোদয়ের রং। কোটলার বহিরঙ্গ এবং অন্তর্সজ্জা দুটোই সেই রঙে আপাতত এমন ভাসমান যে, বেগুনিটাকে মনে মনে সোনালি-হলুদ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
যুগ্ম আশার প্রজ্জ্বলন তৃতীয় দিনের শেষে। আট উইকেটে বাকি ১২৪ রান তুলে ভারত জিতবে। সচিন তেন্ডুলকর শততম সেঞ্চুরিটা সেরে নেবেন।
লেখার অর্ডারে ভুল হল। বাকি ৬৭ রান তুলে সচিন সেঞ্চুরি করে ফেলবেন। তার পর যদি সম্ভব হয়ভারত যেন জেতে। এ দিন সচিন ব্যাট করতে নামার সময় পাশের গ্যালারি অবিরাম চিৎকার করে গেল, ‘শতক লগাও। শতক।’ ভারত তখন বেশ কঠিন অবস্থায়খেলার গতির বিরুদ্ধে সহবাগকে হারিয়ে। কিন্তু সে সব নিয়ে কার মাথাব্যথা রয়েছে। শততম সেঞ্চুরিটা মনে হচ্ছে জাতীয় অবসেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সচিন বা তাঁর পরিবারের যত না চাই তার চেয়ে বেশি করে চাই যেন আম আদমির। স্বাধীনতার চৌষট্টি বছর বাদেও দেশের স্বার্থ ছাপিয়ে মহানায়কের ব্যক্তিগত কীর্তিস্থাপন দেখার এমন আকুলতা, যেন ব্যাপারটা ঘটলেই মূল্যবৃদ্ধি কমে যাবে! বেকারত্বের অবসান ঘটবে! রাজনীতিবিদ আর দুর্নীতিতে জড়াবে না! দেশে খুন-জখম কমে যাবে!
তেন্ডুলকর কখনও আত্মজীবনী লিখলে ধরে নেওয়া যায় অতি অবশ্যই কোটলার সোমবারের বিকেল তার মধ্যে থাকবে। যখন চতুর্থ ইনিংসে এই মাঠের পক্ষে বেশ কঠিন ২৭৬ রানের টার্গেটের সামনে চাপে ধুঁকছে দল। উদ্ধারে তাঁকে নামতে হয়েছিল। কাকে বাঁচাবেন আগে? ব্যক্তিকে? না দলকে? দু’জনেই তো প্রাণপণ নিরাপত্তা চাইছে। দু’জনেই বিপন্ন। একে টিমকে তিনি যথেষ্ট জেতাননি বলে বাজারে রটনা আছে। আর চতুর্থ ইনিংসে যে তাঁর গড় মাত্র ৩৯, প্রথম ইনিংসে ৬১ গড়ের তুলনায় তাঁর প্রবল বৈপরীত্য সেটা তো রটনা নয়। অঙ্ক।
আজ দিনের বাকি পৌনে দু’ঘণ্টা সচিন কাটাতে না পারলে জনতাই চিৎকার করত, দরকারের সময় ফোর্থ ইনিংসে সেই ডোবাল। তা-ও এমন কঠিন পরীক্ষা কোথায়, না এ বারের কোটলা পিচে। আখড়া উইকেট বলা যায়। যেখানে হয়তো বাউন্স নেই। পেস নেই। দারুণ জোর ঘুরছে না। কিন্তু অবিরাম গড়াচ্ছে। প্রথম ইনিংসে তাড়াতাড়ি খেলতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন। আজ (সম্ভবত কালও তাই থাকবে) তাই জীবন থেকে ‘অ্যাক্রস’ খেলা বিসর্জন দিয়েছিলেন। সোজা খেললেন আগাগোড়া। ৮৭ বলে ৩৩ নট আউটে আবার নতুন কীর্তিস্থাপন হয়ে গেল। কোটলার অমর সব ইতিকথায় নতুন সংযোজন। তেন্ডুলকরের ১৫ হাজার রান স্পর্শ। জীবজগতে যা কখনও হয়নি। হবে বলেও বিশেষ আশঙ্কা নেই। কী অদ্ভুত কপাল কোটলার। অভিজাত মাঠ বলে কোনও রকম স্বীকৃতি নেই। অথচ রেকর্ডের পয়া মাঠ। যেমন শততম সেঞ্চুরির চেয়ে কোনও অংশে কম দীপ্যমান নয় পনেরো হাজার রানে পৌঁছনো। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, জনতার কাছে এর টিআরপি নেই। যা আছে একশো সেঞ্চুরির। ইনিংসের গোড়ার দিকে সহবাগের সহজ রিটার্ন ক্যাচ রবি রামপল না ফেললে সচিনের পরীক্ষা আরও ধারালো হত। কিন্তু তাতেও লোকে মনে হয় না জেতা-হারা বা পরীক্ষা কঠিন হওয়া নিয়ে মাথা ঘামাত বলে। তারা তো এখন অন্য কিছুকে পাখির চোখ করে নিয়েছে!
টেস্টের দৃশ্যপট অনেকটাই বদলাল এ দিন। জয়ের মখমলের মতো অবস্থান পেয়েও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘চোক’ করল। সকালে শুরুর দিকে তাদের ব্যাটিং এবং ভারতীয় ওপেনারদের বিরুদ্ধে বোলিংয়ের সময়। এই মহেঞ্জোদড়ো পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া স্যামির ভগ্নদশার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সম্পর্কে কেউ ভাবেনি যে দুর্ধর্ষ। ভাবেনি এরা সেই জো ফ্রেজিয়ার বনাম মহম্মদ আলি টাইপ মারকাটারি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ স্পিরিট আমদানি করবে। কিন্তু আলিকে প্রচণ্ড বেগ দিয়েছে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগও মনে হচ্ছে ক্যারিবীয়রা অপচয় করল।
যে ভাবে ১৫ হাজারে

বিপক্ষ স্থান বছর টেস্ট সংখ্যা
১,০০০ দক্ষিণ আফ্রিকা জোহানেসবার্গ ১৯৯২-’৯৩ ১৯
৫,০০০ পাকিস্তান কলকাতা ১৯৯৮-’৯৯ ৬৭
১০,০০০ পাকিস্তান কলকাতা ২০০৪-’০৫ ১২২
১৫,০০০ ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়াদিল্লি ২০১১-’১২ ১৮২
এ-ও মনে হচ্ছে রবিচন্দ্রন অশ্বিন যত সিরিজ এগোবে তত তাদের বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াবেন। অশ্বিনের ক্যারম বলের কোনও হদিশই পাচ্ছে না ক্যারিবীয়রা। উইকেট থেকে অশ্বিন বাউন্স পেলে তাদের খেলতে আরও অসুবিধে হবে। আবির্ভাবেই নয় উইকেটএত ধুন্ধুমার পারফরম্যান্স একমাত্র নরেন্দ্র হিরওয়ানির আছে। বিপক্ষ সেখানেও ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হিরওয়ানি নিয়েছিলেন ১৬ উইকেট। কিন্তু চিপকের সেই টার্ফে বল বনবন ঘুরেছিল। কোটলাতে এত চকিত টার্ন নেই। ১৬ আর ৯তাই যার যার সংখ্যার দূরত্বে না থেকে অনেক কাছাকাছি বসতে পারে। বরং সমস্যা হয়ে গেল জাতীয় নির্বাচকদের। হরভজন আর অশ্বিন দু’জন অফস্পিনার তাঁরা কী করে পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাবেন। ভারতীয় দলে প্রবল হরভজন সমর্থকেরা মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো জঙ্গি টিম সামলাতে সর্দারের মাঠের দস্যিপনার প্রয়োজন। হরভজন মাঠে থাকা মানেই অস্ট্রেলিয়া বাড়তি চাপে থাকবে। কিন্তু দুটো অফস্পিনার নিলে তো ন্যাটা স্পিনারের জায়গা রইল না। তা হলে প্রজ্ঞান ওঝাকে বাদ দিতে হয়। ঠিক হবে?
কী হবে সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে। যেমন ইডেনের কী হবে যদি সচিনের সেঞ্চুরিটাও কাল হয়ে যায়। কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে সিএবি কর্তারা এমন সোমবার থেকে শুক্রবার ব্যাপী টেস্ট ম্যাচ নিতে রাজি হয়েছেন। যে যুগে লোকে ওয়ান ডে দেখতে আসছে না, সেখানে উইক ডে জুড়ে টেস্ট ম্যাচে তখনই একমাত্র উৎসাহ দেখাবে যদি সচিনের শততম জাতীয় চৌম্বকীয় আকর্ষণক্ষেত্র তৈরি থাকে!
টেস্ট ইতিহাসের সেরা আট

ম্যাচ ইনিংস রান সর্বোচ্চ

গড়

সেঞ্চুরি
সচিন তেন্ডুলকর ১৮২ ৩০০ ১৫০০৫ ২৪৮* ৫৬.১৯ ৫১
রাহুল দ্রাবিড় ১৫৮ ২৭৫ ১২৮৫৯ ২৭০ ৫৩.১৩ ৩৫
রিকি পন্টিং ১৫৪ ২৬৩ ১২৪৮৭ ২৫৭ ৫৩.১৩ ৩৯
ব্রায়ান লারা ১৩১ ২৩২ ১১৯৫৩ ৪০০* ৫২.৮৮ ৩৪
জাক কালিস ১৪৫ ২৪৬ ১১৯৪৭ ২০১* ৫৭.৪৩ ৪০
অ্যালান বর্ডার ১৫৬ ২৬৫ ১১১৭৪ ২০৫ ৫০.৫৬ ২৭
স্টিভ ওয় ১৬৮ ২৬০ ১০৯২৭ ২০০ ৫১.০৬ ৩২
সুনীল গাওস্কর ১২৫ ২১৪ ১০১২২ ২৩৬* ৫১.১২ ৩৪
নট আউট*
কোটলা প্রেসবক্স থেকে রাত্তিরে বার হতে হতেও যেমন ভিনরাজ্যএই শহরে তাবড় সাংবাদিককুলে জল্পনা চলছে বাকি ১২৪ রানের মধ্যে দরকারি ৬৭ তোলা নিশ্চিত করার জন্য রাহুল দ্রাবিড় কি ইচ্ছে করে নিজে কম স্ট্রাইক নেবেন? না কি ভারতের জেতার কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর এ সব মাথাতেই থাকবে না? না কি সব কিছু অবান্তর ঘোষিত করে সকাল সকাল একটা দ্রুত মারণ ডেলিভারি হাজির হবে? যাই হোক, একটা কথা বলা উচিত। তৃতীয় দিনের শেষে এ বারের কোটলা পিচকে মনে মনে অনেক ক্রিকেট রোম্যান্টিকই ধন্যবাদ দেবেন। উইকেটের বীভৎসতাতেই তো দিনের শেষে ছাব্বিশ ওভার এমন ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যানশিপ দেখা গেল। সচিন-দ্রাবিড় যখন ক্রিজে। দেবেন্দ্র বিশু এবং ডারেন স্যামি টানা উইকেট টু উইকেট বল করে গেলেন। মিস করলেই প্রথম এলবি। পরে বোল্ড। আর এরা বিশ্বক্রিকেটের সর্বকালের প্রথম ও দ্বিতীয় রান সংগ্রহকারী কী পরম যত্নে মাথা নিচু করে সাবেকি ক্রিকেটের মেজাজে ঢুকে গেলেন। কোনও ঝুঁকি নয়। কোনও অ্যাডভেঞ্চার নয়।
পনেরো হাজার ছুঁয়ে। মঙ্গলবার কোটলায়। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
কোনও ফ্ল্যামবয়েন্স নয়। মাথা নিশ্চল। শরীর বলের একেবারে লাইনে। যথাসম্ভব ফরোয়ার্ড খেলো। এই পিচকে বিশ্বাস নেই। এক কথায় ক্রিকেটের রাজাধিরাজের বেশটেশ ছেড়ে কয়লাখনির শ্রমিকের পোশাকটা পরে নেওয়া। আজ যে ঐশ্বর্যের দিন নয়। মধ্যবিত্ততার।
ঠিক আগেই বীরেন্দ্র সহবাগের চিত্তাকর্ষক হাফসেঞ্চুরি ঘটে গিয়েছে। ইগো থাকা সুপারস্টারের অবধারিত মনে হবে, ও এত সহজে মারল। আমি ঠুকলে তো পাবলিক ভাববে স্কিলে আমি পিছিয়ে রয়েছি। না সচিন, না দ্রাবিড় কেউ সেই প্রতিযোগিতায় যাননি। মনে রেখেছেন একটা সরল সত্য। তুমি যে-ই হও, ক্রিকেটের সাবেকি নিয়মের ঊর্ধ্বে নও। আর আজ নিয়ম মেনে চলার পরিস্থিতি। বিদ্রোহের নয়। খেলাটার কাছে নতজানু হও। এটাই তো তোমার প্রার্থনা!
রবিচন্দ্রন অশ্বিনের যদি শেখার মন থাকে, প্রথম টেস্ট থেকে নয় উইকেটের চেয়েও দামি শিক্ষা তাঁর চোখের সামনে!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস : ৩০৪
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ২১-২)
ভারত প্রথম ইনিংস: ২০৯
কার্ক এডওয়ার্ডস বো উমেশ ৩৩
ফিডেল এডওয়ার্ডস ক ধোনি বো ইশান্ত ১
ব্র্যাভো এলবিডব্লিউ অশ্বিন ১২
চন্দ্রপল এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৪৭
স্যামুয়েলস বো অশ্বিন ০
বাও ক ধোনি বো উমেশ ৭
স্যামি বো অশ্বিন ৪২
রামপল ক প্রজ্ঞান বো অশ্বিন ১৮
বিশু ন.আ. ৯
অতিরিক্ত
মোট ১৮০।
পতন: ০, ১৭, ২৬, ৫৩, ৬৩, ৬৩, ৮৪, ১২৪, ১৫৭।
বোলিং: প্রজ্ঞান ১৪-৪-৩৭-১, অশ্বিন ২১.৩-৫-৪৭-৬, যুবরাজ ১-০-২-০, ইশান্ত ১৪-২-৪৯-১, উমেশ ৭-০-৩৬-২।
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস
গম্ভীর এলবিডব্লিউ স্যামুয়েলস ২২
সহবাগ বো স্যামি ৫৫
দ্রাবিড় ব্যাটিং ৩০
সচিন ব্যাটিং ৩৩
অতিরিক্ত ১২
মোট ১৫২-২।
পতন: ৫১, ৯৫।
বোলিং: ফিডেল এডওয়ার্ডস ৯-২-৩২-০, রামপল ৮-০-১৯-০, স্যামি ৯-০-৩২-১, স্যামুয়েলস ৭-০-২৮-১, বিশু ১১-১-৩০-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.