ডিজেল, রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ জোট সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে ‘বাধ্য’ হবে তৃণমূল। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তৃণমূল সাংসদদের বৈঠকের পর কলকাতায় জানিয়ে দিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দলের একাংশ মমতার এই অবস্থানকে ‘চরম হুঁশিয়ারি’ বলে ব্যাখ্যা করলেও তৃণমূল নেত্রী কিন্তু পাশাপাশিই বলেছেন, “আমরা (সরকার) ছেড়ে আসতে চাই না। কিন্তু আমাদের তো মানুষের কাছে একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে! আমাদের বাধ্য করলে আমরা কী করব!” তৃণমূল জোট ছেড়ে বেরিয়ে এলে কেন্দ্রের সরকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু মমতার বক্তব্য, “গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি জোটে হয় না। ওঁরা বলতে পারেন, তৃণমূলকে প্রয়োজন নেই। তা হলে তৃণমূল সরে আসবে। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।”
অর্থাৎ, শেষ পর্যন্ত কোনও চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে যদি ইউপিএ সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতেও হয়, তা হলে তার ‘দায়’ কেন্দ্রের উপরই রাখতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী। |
পেট্রোলের দাম নিয়ে কানে যে কথা বলেছিলেন, এ দিন তৃণমূল প্রতিনিধিদের সামনেও সেই একই অবস্থানে অনড় থাকেন প্রধানমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও তাঁরা কোনও ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত নিতে চান না দাবি করে মমতা এ দিন বলেন, “হুটহাট করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, পেট্রোলের বর্ধিত দাম কমানো (পরিভাষায় ‘রোল-ব্যাক’) হবে না। এটা ওঁদের ব্যাপার। তৃণমূল এর সঙ্গে একমত নয়।” মমতার আরও বক্তব্য, “আমরা কখনও কোনও চরম সিদ্ধান্ত নিইনি। কারণ, আমরা বুঝি তেমন সিদ্ধান্ত নিলে তা ব্যুমেরাং হতে পারে!” ‘ব্যুমেরাং-তত্ত্ব’ সংক্রান্ত মমতার বক্তব্যের এই দ্বিতীয়াংশ থেকে তাঁর ‘হুঁশিয়ারি’কে এক দিকে যেমন কেন্দ্রের উপর ‘চাপ’ তৈরি, তেমনই অন্য দিকে আমজনতার প্রতি ‘বার্তা’ বলেই মনে করছেন দলের গরিষ্ঠ অংশ। দলের নেতাদের একাংশের মতে, রাজ্যে সরকার চালাতে গেলে মমতার কেন্দ্রীয় সরকারকে দরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে এলে রাজ্যে রেলের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজও আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে জন্য তিনিও কোনও ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত নেবেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে এ দিন পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যুক্তি দিয়েছেন, তার পর মমতার পক্ষেও একেবারে ‘নীরব’ থাকা অসম্ভব ছিল। ফলে তাঁকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিতেই হয়েছে। বিশেষত, যখন মাত্র ২০ দিন পরেই দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন!
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী ও সাংসদ জানিয়েছেন, জোটে থাকার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী ‘যথেষ্ট নরম’ (এক্সট্রিমলি সাবমিসিভ) মনোভাব দেখিয়েছেন। কিন্তু পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নিজের বক্তব্য বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি সাফ জানিয়েছেন, পেট্রোলের বর্ধিত মূল্য কমানো যাবে না। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ১৯৯১ সালে সংস্কারের আগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রা যা থাকত, তা দিয়ে দু’সপ্তাহও চলত না। সেই অবস্থায় আর দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক চাপে সরকার তেলের দাম কমিয়ে রাখলে বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল সঙ্কেত যাবে। তারা ভাববে, সরকার ‘দৃঢ় পদক্ষেপ’ করতে পারছে না। গ্রিসের উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, ভর্তুকি দিয়ে চালিয়েই গ্রিসের এই সঙ্কটজনক অবস্থা হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বার দেখা করা তৃণমূলের এক শীর্ষ স্থানীয় নেতার মতে, নিজের অবস্থানে এতটা অনড় মনমোহনকে আগে তিনি কখনও দেখেননি।
পক্ষান্তরে, মমতার বার্তা অনুসারেই তৃণমূল সাংসদরা বৈঠকে জানিয়েছেন, অনবরত এই মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। দলের মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে ভারতে তা বাড়ছে। ঠিক তেমনই যখন তা কমবে, তখনও যেন সঙ্গতি রেখে দেশে কমানো হয়। সম্প্রতি পাকিস্তানে তেলের দাম না-বাড়ানোর উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের দাবি, প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে তেলের দামের ‘মেকানিজমও’ খতিয়ে দেখবেন বলে প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন।
মোদ্দা কথায়, বৈঠকে দু’পক্ষই নিজের নিজের যুক্তি দিয়েছে। যে বৈঠক, দলের এক সাংসদের বর্ণনায়, “মিটিং বিটুইন পলিটিক্যাল অ্যানিম্যাল্স অ্যান্ড অ্যান ইকনমিক অ্যানিম্যাল!” যে কারণে বিধানসভায় তৃণমূলের উপনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় (এ দিন প্রতিনিধি দলে একমাত্র অ-সাংসদ তিনিই) মনমোহনকে বলেন, “অর্থনীতিবিদ হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করুন।”
পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে বিস্তারিত যুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলকে সরকার ছেড়ে বেরিয়ে না-যাওয়ার আন্তরিক আবেদন জানিয়েছেন। অন্তত বৈঠকে উপস্থিত সাংসদদের বক্তব্য তা-ই। কারণ, মনমোহনও বিলক্ষণ জানেন, মমতা সরকার ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সরকার পতনের আশঙ্কা প্রবল। ফলে তাঁর তরফেও ‘বাধ্যবাধকতা’ রয়েছে। সেই বিচারে মমতা খানিকটা ‘সুবিধাজনক’ অবস্থায়। রাজ্যে সরকার চালানোর জন্য তাঁর কংগ্রেসকে দরকার নেই।
তবে বিদেশ সফরে থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীই জানিয়েছিলেন, সমস্ত পেট্রোপণ্যের মূল্য বিনিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। যার অর্থ, তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির হাতেই পেট্রোপণ্যের দাম বাড়া-কমার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ক্ষমতা থাকবে না। এখানেই তৃণমূলের আপত্তি। মমতার কথায়, “তেল কোম্পানিগুলো তো ‘ফরচুন ফাইভ-হান্ড্রেড’-এর তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ, তারা সরকার অনুমোদিত। সরকারের অজ্ঞাতসারে এ সব সিদ্ধান্ত হয় না। আমি তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ছিলাম। আমি এগুলো জানি!”
এ দিনই রাজভবনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক ছিল মমতার। দু’টি বৈঠকই প্রায় একই সময়ে শেষ হয়। রাজভবনে বসেই তৃণমূল নেত্রী দলের শীর্ষনেতা মুকুল রায়ের মারফৎ জেনে যান দিল্লির বৈঠকের সবিস্তার বিবরণী। রাজভবনের গেটে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী কথা হয়েছে, দলের সাংসদরা আমায় জানিয়েছেন। আমরা (সাংসদরা) প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, যত বার তেলের দাম বাড়বে, আমরা প্রতিবাদ করব।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা যতটা সুর চড়িয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তৃণমূল সাংসদদের বৈঠকের সুর ততটা ‘চড়া’ ছিল না (তৃণমূল সাংসদদের সময় দেওয়ার জন্য মমতা নিজেও প্রধানমন্ত্রীকে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানিয়েছেন)। বৈঠকে উপস্থিত এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, “কোনও তরফেই কোনও রণং দেহি মনোভাব ছিল না। দু’পক্ষই দু’পক্ষের বক্তব্য বলেছে এবং শুনেছে।”
তবে বৈঠক চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েক বার তৃণমূল সাংসদদের বলেছেন, তিনি অনুরোধ করছেন (‘আই বেগ অফ ইউ’), যাতে তৃণমূল সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো কোনও সিদ্ধান্ত চটজলদি নিয়ে না-বসে। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্ব যে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত, সে কথা তৃণমূল নেতাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য দিকে, বৈঠকে উপস্থিত এক তৃণমূল নেতার কথায়, “উনি বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরিক। তাঁকে কোনও মতেই হারাতে চায় না সরকার। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলে আমজনতার উপর যে বোঝা বাড়ে, সে সম্পর্কে তিনিও আমাদের মতোই অবহিত। কোনও উপায় থাকলে দাম বাড়াতেন না। তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের উপর চাপ বাড়ুক সেটা তিনিও চান না। কিছু ক্ষেত্রে তিনি অসহায়। কিন্তু তিনি তৃণমূলকে আহত করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চান না।”
যা জেনে মমতা পাল্টা বলেন, “প্রধানমন্ত্রী যদি নির্দিষ্ট করে বলতেন, আর মূল্যবৃদ্ধি হবে না, তা হলে আমাদেরও এমন কোনও কথা বলতে হত না। কিন্তু যদি আমাদের এ ভাবে বাধ্য করা হয় সরকার ছেড়ে আসতে, তা হলে আমরা কী করব! আমাদেরও তো ধৈর্যের একটা সীমা আছে! গত ১২ মাসে ১১ বার দাম বাড়ানো হয়েছে। গত আড়াই বছর ধরে ওঁরা যা বলেছেন, আমরা শুনেছি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে এখানেও দাম বাড়াতে হয়, উনি সেই যুক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমলে তো এখানে দাম কমানো হচ্ছে না!”
এ দিন বৈঠকে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অন্তত ১৫ মিনিট নিজস্ব যুক্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পর তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদেরা। ঘটনাচক্রে, দলের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন গোটা বৈঠকেরই বিবরণী তাঁর আইপ্যাডে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আইপ্যাড বা মোবাইল নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ। কিন্তু বৈঠকের বিবরণী লেখার জন্য আইপ্যাড এবং বৈঠকের অব্যবহিত পরে মমতার সঙ্গে মুকুলবাবুকে কথা বলতেই হবে জানিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের বিশেষ অনুমতি নিয়ে নিজের আইপ্যাড এবং মোবাইল নিয়েই ভিতরে গিয়েছিলেন ডেরেক। বৈঠকের পর সেই ফোনেই মুকুলবাবু সবিস্তার জানান দলনেত্রীকে)।
তবে আগামী ২১ নভেম্বর ডিজেল, রান্নার গ্যাস ও কেরোসিনের প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু জানেন না বলে তৃণমূল সাংসদদের জানিয়েছেন। বৈঠকে তিনি রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীকে বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বা মন্ত্রিগোষ্ঠীতে এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে সেটা দীনেশের বাইরে জানানো উচিত হয়নি! তখন দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, তাঁরা দীনেশের কাছে কিছু শোনেননি। তাঁরা জয়পালের বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে পড়েছেন। ইউপিএ-২ সরকারের শরিকদের নিয়ে ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠনের প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার আগে যেন তা কমিটিতে আলোচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বলেছিলেন, তৃণমূল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রয়েছে। রেলমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে দীনেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকেও থাকেন। ফলে তাঁদের অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা ঠিক নয়। তখন প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়, ‘সরকারি স্তরে’ নয়, ‘রাজনৈতিক স্তরে’ সমস্ত শরিকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হোক। যে কমিটিতে শরিকরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মতামত দিতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী ওই কমিটি গঠনের বিষয়ে ‘আশ্বাস’ দিয়েছেন বলেই তৃণমূল সাংসদদের দাবি। |