এই দেশের মধ্যেই যেন রয়েছে আরও একটি দেশ। সেই দেশের আছে লিখিত সংবিধান। সেই সংবিধানের আছে ২৮টি ধারা। লোকজন পুলিশের কাছে যায় না। যদি কেউ ‘ভুল’ করে চলেও যায়, তার জন্য আছে আলাদা আইন। পাইক-বরকন্দাজ বিশেষ নেই। তবে আছে মোড়লের রক্তচক্ষু। সেই চক্ষুকে ডরায় না, এমন হিম্মৎ কার? এই সর্বনেশে আইনকানুন চলছে সেই ’৭৩ সাল থেকে। সরকার নাকি জানে না, পুলিশ জেনেও জানে না। হাওড়ার আমতায় মানিকুরা গ্রামে ষোলো আনা কমিটিই সুপ্রিম কোর্ট।
কী এই ষোলো আনা কমিটি?
এটি হল গ্রাম বাংলার একটি সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা। মূলত গ্রামের মাতব্বর গোছের লোকজন থাকেন এই কমিটির মাথায়। আগে যেমন চণ্ডীমণ্ডপের আটচালায় বিচারসভা বসত, এটাও অনেকটা তেমনই। গ্রামের নানা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান করে এই কমিটি। মাতব্বরদের বিধান না-মানলে হতে হয় একঘরে। তবে কমিটির লিখিত সংবিধান থাকার কথা বড় একটা শোনা যায় না। মানিকুরা সেদিক থেকে ব্যতিক্রমী।
চারটি পাড়া নিয়ে মানিকুরা গ্রাম। গ্রামের মাথায় আছে ষোলো আনা কমিটি। প্রতিটি পাড়াতে রয়েছে একটি করে ঘণ্টা। ষোলো আনা কমিটির সালিশি সভা শুরুর আগে সেই সব ঘণ্টা একযোগে বেজে ওঠে। অনেকটা যাত্রাপালার কনসার্টের মতো। দলে দলে গ্রামবাসীরা হাজির হন সালিশি সভায়। সভার রায় মানলে ভাল, না-মানলে শাস্তি। যেমন শাস্তি পেয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান মল্লিক। তিনি সভার রায় মানেননি। তাই তিনি একঘরে।
বিয়ে থেকে শুরু করে সম্পত্তি কেনাবেচা, কীসের বিচার হয় না এখানে! যেমন, সংবিধানের ২৮ নম্বর ধারায় আছে, ‘মানিকুরা গ্রামের সমস্ত ভূ-সম্পত্তির ক্রয়-বিক্রয় কার্যাদি ষোলো আনার জ্ঞাতার্থে হইবে।’ ২২ নম্বর ধারায় আছে, ‘বরযাত্রীর ক্ষেত্রে পাড়ার অনুপাত থাকিবে প্রতি দশ জনে তিন জন এবং এই অনুপাতেই ওলিমা (বৌভাত)-তে পাড়া হইতে লোক লইতে হইবে।’
মীরেপাড়া, উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া এবং মাঝেরপাড়া। এই চারটি পাড়া আছে মানিকুরা গ্রামে। প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে পাড়া কমিটি। সবার উপরে ষোলো আনা কমিটি। ছোটখাটো সমস্যা মেটানো হয় পাড়া কমিটিতে। পাড়া কমিটির বিচার না-পসন্দ হলে ষোলো আনা কমিটি। সেখানে ‘আপিল’ করা যায়। ৫ টাকা ফি দিয়ে।
যে পাড়ার সমস্যা, ষোলো আনার বিচার বসে সেই পাড়াতেই। ষোলো আনার কর্তারা সদলবলে হাজির হন বিচারস্থলে। বিচার বসে বিকেলে বা সন্ধ্যায়। বিচার শুরুর আগে বেজে ওঠে ঘণ্টা।
৬৫ বছরের বৃদ্ধ মোস্তাফিজুরের অভিযোগ, গত ৪ জুলাই তাঁর বাগানে জোর করে ঢুকে কয়েক জন যুবক গাছ কেটে নেয়, বাগানের বেড়া ভেঙে দেয়। প্রতিবাদ করলে তাঁর স্ত্রী, নাবালক দুই ছেলেমেয়েকে মারধর করা হয়। মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন মোস্তাফিজুর। পুলিশ এক জনকে গ্রেফতার করে।
থানায় অভিযুক্তেরা ষোলো আনার কাছে বিচার চান। মোস্তাফিজুরকে ডেকে পাঠানো হয়। কেন তিনি থানায় গিয়েছিলেন, তার জন্য ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি গ্রামবাসীদের কাছে বাধ্য হয়ে ক্ষমা চান। বিচারকের হুকুম, আট জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিতে হবে। যাঁরা বিচারপ্রার্থী ছিলেন, তাঁদেরও অবশ্য ক্ষমা চাওয়ানো হয়। মোস্তাফিজুরকে জরিমানা করা হয় ২০০০ টাকা। মোস্তাফিজুরের দাবি, সালিশি সভার চাপে পড়ে তিনি সব শর্তই মেনে নেন।
কিন্তু মামলা তুলতে তিনি থানায় গেলে তাঁকে বলা হয়, অভিযুক্তদের জামিন নিতে হবে। তবে মামলা উঠবে। গত ৩০ অক্টোবর ফের সালিশি সভা বসে। মোস্তাফিজুরকে ডাকা হয়। কিন্তু তিনি যাননি। সালিশি সভায় একতরফা সিদ্ধান্ত হয়, আট জনের জামিনের জন্য যে ১৩ হাজার টাকা লাগবে তা মোস্তাফিজুরকেই দিতে হবে। মোস্তাফিজুর বলেন, “একটি পয়সাও দেব না। যারা আমার সম্পত্তি নষ্ট করল, মারধর করল তাদের জামিনের টাকা দিতে হবে আমাকেই? আমি পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি।” এর পরেই মোস্তাফিজুরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকে ‘সামাজিক বয়কট’ করা হল।
ষোলো আনা কমিটির অন্যতম সভাপতি আইনেল মল্লিক অবশ্য বলেন, “ভুল তো মোস্তাফিজুরই করেছেন। তিনিও তো ষোলো আনার সদস্য। থানায় গেলেন কেন?” ‘সামাজিক বয়কট’ প্রসঙ্গে আইনেল বলেন, “সালিশি সভার রায় না-মেনে মোস্তাফিজুর অন্যায় করেছেন। সেই কারণেই গ্রামের মানুষ তাঁর সঙ্গে মিশতে চাইছেন না।” মোস্তাফিজুর বলেন, “কমিটির সংবিধান অনুযায়ী গ্রামের সবাই নাকি ষোলো আনার সদস্য। কিন্তু এটা তো হতে পারে না! আমি জানিই না, আমি সদস্য কি না। এটা তো জবরদস্তি। এখানে বিচারের নামে অত্যাচার সীমা ছাড়িয়েছে।”
গ্রামে শিক্ষার হার বেশ ভাল। অনেকে কলকাতায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। বহু লোক এই ব্যবস্থাকে সমর্থনও করেন। মোস্তফা মল্লিক, সৈয়দ রহমান খন্দকার, মানোয়ার আলি, মোশারফ হোসেনরা বলেন, “একসময়ে আমাদের গ্রামে খুব গোলমাল হত। তার জন্য ১৯৭৩ সাল থেকে এই সালিশি সভা চালু করা হয়। এতে আমরা ভাল আছি।” তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য হায়দর আলিও এর পক্ষে সওয়াল করেন। তাঁর যুক্তি, “এতে লাভই হচ্ছে। অহেতুক থানা-পুলিশ করতে হয় না।”
জেলা পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ-সব যে চলছে, আমি জানতামই না। মোস্তাফিজুরের অভিযোগও হাতে পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করা হবে। মগের মুলুক নাকি?” |