সচিনের প্রস্তুতি-যজ্ঞে উদাসীন কোটলা
প্রার্থনার ধরনটা চার রকমে বিভক্ত হয়ে রয়েছে!
কোটলাতেই হয়ে যাক বাবা। চুকে যাক তাড়াতাড়ি। টেনশন যে আর সহ্য হচ্ছে না গড়পড়তা ক্রিকেটপ্রেমীর।
এক। কোটলা রান দিলে যেন ৯৯ অবধি দেয়। ব্যাপারটা ঘটুক ঐতিহ্যশালী ইডেনে আবেগে ভিজিয়ে দেওয়া বাঙালি দর্শকের সামনে।
দুই। মুম্বইতে হোক। মরাঠি মানুষ ঘরের মাঠে কীর্তিমান হোক ঘরের ছেলের অক্ষয় কীর্তিতে।
তিন। অস্ট্রেলিয়াতে হোক। এ হেন দীনদরিদ্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ঘটলে উপযুক্ত মর্যাদা না-ও পেতে পারে। তার চেয়ে মহারেকর্ড অনেক বেশি আভিজাত্য পাবে ডনের দেশে উৎপন্ন হলে। চার।
চার নম্বরটা অবশ্যই রোম্যান্টিক দর্শন। যার তীব্র বিরোধিতা করে এ দিন মুম্বই থেকে সচিন তেন্ডুলকরের বাল্যবন্ধু বললেন, “ঘোড়ার ডিমের রোম্যান্টিসিজম। সচিন হল এই দেশ থেকে তৈরি ব্যাটিং ঈশ্বর। তার কীর্তি বিদেশে হবে কেন? দেশে হবে।” বন্ধুর নাম বিনোদ কাম্বলী। সেই ‘সচ কা সামনা’ উপাখ্যানের পর থেকে তেন্ডুলকরদের ড্রয়িংরুমের ভিসাটা যাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। দুষ্টু লোকেদের মতে, চিরকালের জন্য গিয়েছে।
তবু কাম্বলিকে বন্ধুর শততম সেঞ্চুরির মানসিক প্রস্তুতি-যজ্ঞে আকুল শোনাল। একা কাম্বলি-ই বা কেন? পুরনো প্লেয়ার। নতুন প্লেয়ার। পিচ প্রস্তুতকারক। প্র্যাক্টিস বোলার। মন্ত্রী। আমলা। মিডিয়া। সবাইকে একই রকম আলোড়িত দেখাচ্ছে কবে ঐতিহাসিক মাইলস্টোনে হাত পড়বে তেন্ডুলকরের? যা মেক্সিকোয় বব বীমনের লং জাম্প। মন্ট্রিয়লে নাদিয়া কোমানেচির পারফেক্ট টেন। রজার ব্যানিস্টারের চার মিনিটে মাইল দৌড়। মহম্মদ আলির বিশ্বখেতাব। ফেডেরারের গ্র্যান্ড স্লাম। পেলের হাজার গোল। ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ নিয়ে শেষ করার মতোই অবিস্মরণীয় কীর্তিস্তম্ভ হতে যাচ্ছে।
অনুশীলনে সচিন। ছবি: শঙ্কর নাগদাস
শোনা যায়, জ্যোতি বসুর শেষ দিকের চরম অসুস্থতার সময় কলকাতার কিছু দৈনিক আগাম তাঁর শোকগাথা, তাঁকে নিয়ে বেশ কিছু লেখা করিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ মাঝরাত্তির-টাত্তিরে খবর এলে যাতে অপ্রস্তুতে পড়তে না হয়। সচিনেরটাতেও শোনা যায়, ব্যাপারটা সেই। চোখের সামনে দেখছি, সময় এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ার বড় অংশের অস্থিরতা। এ বার হবে তো? আর কত অপেক্ষা করব? টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করে বসে রয়েছে। হলেই ওই বিশেষ মুহূর্তের ফুটেজটা যোগ করে দেবে শুধু। বাকি তো রেডি। এজেন্সি রিপোর্টার এ দিন কোটলা মাঠে অপেক্ষা করছিলেন, একটা প্যাকেজ হান্ড্রেড্থ সেঞ্চুরির ওপর তৈরি হয়ে সেই কবে থেকে পড়ে রয়েছে। আর এ-দেশ ও-দেশ ঘুরছে। ওয়ার্ল্ড কাপে হল না। ইংল্যান্ডে হল না। এ বার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও না হলে ফের প্যাকেজটা ছুটবে অস্ট্রেলিয়া। কাগজের অফিসের মার্কেটিং কর্তারা ধীর আগ্রহে বসে আছেন, শততম সেঞ্চুরি মানেই অনিবার্য ভাবে বার হবে বিশেষ বিজ্ঞাপন ক্রোড়পত্র। তার জন্য আগাম লেখা নিয়ে অনেক কাগজ বিদেশি লেখকদের পেমেন্টও করে বসে আছে। নাগপুরে ১২ মার্চ এসেছিল ৯৯তম সেঞ্চুরি। তার পরে প্রায় আট মাস ধরে শুখা চলছে বলে এত টেনশন। উৎসাহী সকলের কেবল একটা স্বপ্নে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ভেসে বেড়ানো। ডেলিভারি কবে হবে কেউ জানে না। আর তাই যত দেরি হচ্ছে, ব্যাকুলতা বাড়ছে।
শনিবার তেন্ডুলকরকে দেখে এই প্রথম মনে হল, মনে মনে এ বার তিনিও ব্যাকুল হয়ে পড়ছেন। টিমমেটরা যদিও স্বয়ং ঘোড়ার মুখ থেকে শুনেছে, সচিন বিশেষ কোনও টার্গেট সামনে রেখে এই মুহূর্তে এগোচ্ছেন না। তাঁর লক্ষ্য ভাল ব্যাট করা। আর সেটা সফল ভাবে করার লেজুড় হিসেবে যদি সেঞ্চুরিটা উঠে আসে তা হলে অতি উত্তম। কিন্তু প্রথম বল থেকেই আমার সেঞ্চুরি চাই, সেঞ্চুরিএমন কোনও ভাবনা নেই।
যদি এটাই সত্যি হয়, তা হলে প্রথম টেস্ট শুরুর আগের দিন তেন্ডুলকরকে দৃশ্যত অধৈর্য দেখাবে কেন? নেটে লম্বা ব্যাট করলেন। আর নকিং নয়। তার পর দৌড়ে গেলেন কোটলা পিচ প্রস্তুতকারকের কাছে। দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। সচরাচর এগুলো তাঁর প্র্যাক্টিস রুটিনের অন্তর্গত নয়।
আর একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। সচিনের কীর্তিতে হাত রাখা আর সম্ভাব্য কীর্তিস্থল এই দু’টোর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের বিশাল ফারাক। প্রথমটা যদি মহা আকর্ষণ হয়, পরেরটা বিকর্ষণ। কোটলাতে বাকি সেন্টারগুলোর মতোই টিকিটের দাম কমিয়ে জুনিয়রদেরও প্রায় সিনিয়র সিটিজেন রেটে মাঠে আসতে আহ্বান করা হচ্ছে। তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরি ঘিরে যেমন বিশাল শিল্প স্থাপনের তোড়জোড় সম্পূর্ণ, টেস্ট ক্রিকেট নামক কোটলায় ক্রিকেট দেখার এই শিল্পে কারও বিশেষ উৎসাহ নেই। কুতুব মিনারের তলায় যে কুতুব ফেস্টিভ্যাল কাল সুনিধি চৌহানের গানে উদ্বোধন হল সেখনে আজ থেকে পরপর গাইছেন সোনু-শ্রেয়া-সুখবিন্দর সিংহেরা। কুতুবের সেই পাস নিয়ে বরং উত্তেজনা বেশি এবং কাল যদি হাজার দর্শকও টিকিট কেটে কোটলায় ঢোকেন, তা হলে প্রথম টেস্টের টসজয়ী অধিনায়কের চেয়েও বেশি পুলকিত দেখাবে ডিডিসিএ কর্তাদের।
আট বছর পর ভারত সফরে এল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অথচ তাদের সাম্প্রতিক এমন দৈন্যদশা যে, লড়াই তৈরি করতে পারবে এই ধারণাই আগাম খানখান। বাংলাদেশে সদ্য সিরিজ জিতে এলে কী হবে। মাত্র আঠারো দিন আগে এরাই যে চট্টগ্রামে ৬১ অলআউট হয়েছিল কেউ ভোলেনি। বাজারে যেটা খাচ্ছে তা হল, ভারত এদের ইজি হারাবে। এ বারে আসল আকুতির জায়গাটাসেই হারানোর ভেতর যেন শততম সেঞ্চুরিটা থাকে! যেটা দাঁড়াল, একটা বিশাল মন্দির সামনে খাড়া। তা নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই। অথচ মন্দিরের একটা ছোট ভাস্কর্য ঘিরে দমফাটানো কৌতূহল। আকর্ষণ এবং বিকর্ষণের এমন অদ্ভুত সহাবস্থান ভারতীয় খেলার মাঠে আর কখনও ঘটেছে কি না সন্দেহ। ম্যাচ প্রিভিউয়ের দিন গুণগত পারস্পরিক আলোচনার পাট উঠে গিয়েছে। কেউ ভাবছে না ভারত যে বোলিং আক্রমণ নিয়ে সিরিজ শুরু করছে তা ইদানীং কালের অনভিজ্ঞতম। ইশান্ত আর প্রজ্ঞান ওঝাকে সরিয়ে নিলে অশ্বিন আর হয়তো বরুণ অ্যারন। বোলিং লাইন আপের মোট টেস্ট খেলার সংখ্যা মাত্র ৪৯। আর এটাও কেউ ভাবছে না, ভারতীয় দলে তিন জন চোট সারিয়ে ইংল্যান্ডের পর প্রথম দলে ফিরছেন। সচিন, সহবাগ, যুবরাজ। কেউ ভাবছে না, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিং অশ্বিনের ক্যারম বলে যদি বা বিপন্ন হয়, তাদের বোলিংয়ের ক্ষমতা আছে বিপক্ষকে বিপন্ন করার। লেগ স্পিনার বিশুকে সরিয়ে রাখছি। পেস আক্রমণের দিকে তাকান না! ফিডেল এডওয়ার্ডস, কেমার রোচ, রবি রামপল। তিন জনেই ঘণ্টায় নব্বই মাইল গতিতে বল করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের দাবি অনুযায়ী তিন জনই ফিট। মনে করা যাক, ঠাং করে সহবাগের হেলমেটে লাগালেন এডওয়ার্ডস। লক্ষ্মণের হাতে মারলেন রামপল। তখন দু’টো-একটা ডেলিভারিতে তো সিরিজ নাটকীয় হয়ে পড়বে। কোটলা ক্রিকেট রেকর্ড ভক্ষকদের যত প্রিয় সারফেস, ইডেনও নয়। কুম্বলের দশ উইকেট। গাওস্করের ২৯তম সেঞ্চুরি। সচিনের ৩৫তম সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরির শাহেনশা হয়ে যাওয়া। সব এখানে। কোটলা অবশ্যই সচিনের ব্যাটিং অমরত্বের নিশান হতে চাইবে। এ মাঠে ৮ টেস্টে তাঁর ৬৪৩ রান, গড় ৪৫.৯২। সেঞ্চুরি দুটো। আহামরি কিছু নয়। বরং তাঁর চেয়ে উন্নত ব্যাটিং হিসেব রাহুল দ্রাবিড়ের। ৭ টেস্টে ৫০ গড় নিয়ে ৫৫০ রান। যার মধ্যে একটা ডাবল সেঞ্চুরি।
অথচ রাহুলকে নিয়ে জনশূন্য কোটলায় কোনও উৎসাহ হাজির নেই। এমনিতেও ক্রিকেটারদের বাসের পিছু পিছু যে জনতার ভিড় ছোটে। যারা বাস ঘিরে পুলিশের লাঠির মধ্যে অকুতোভয় দাঁড়িয়ে থাকে তারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছানির্বাসনে। কিন্তু মিডিয়ারও মনে হল না খেয়াল আছে বলে যে, আর একটা শোকগাথা নিয়ে পরিকল্পনা করা জরুরি হয়ে পড়ছে। রবিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে যে নতুন ক্রিকেট মরসুম শুরু হচ্ছে তার ভেতর সাতখানা টেস্ট। কোটলায় শুরু। অ্যাডিলেডে শেষ। শোনা যাচ্ছে শেষ অনুষ্ঠানকেন্দ্রটায় টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেবেন দ্রাবিড়। ঘনিষ্ঠ মহলের আলোচনা অনুযায়ী আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন দীর্ঘায়ত করতে চান না। ডনের মাঠেই শেষ।
সে ক্ষেত্রে ঘরের মাঠে এটাই রাহুল শরদ দ্রাবিড়ের শেষ টেস্ট সিরিজ। শততম সেঞ্চুরির আগাম অর্ডারি সানাইয়ের সঙ্গে তার মানে বেহালার করুণ সুরও মিশে থাকা উচিত। আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ দুই বিপরীতমুখী আবেগের মতোই একই ম্যাচে উৎসব আর শেষযাত্রার সহাবস্থান।
কন্ট্রাডিকশনে ভরপুর এমন টেস্ট ম্যাচ ভারতীয় জমিতে কখনও নিশ্চয়ই হয়নি!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.