শব্দে, আলোয়, জনারণ্যে কৃষ্ণনগর এখন উৎসবনগরী। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই প্রতিমা দর্শন শুরু হয়েছিল। শুক্রবার সকাল থেকেই বাসে, ট্রেনে বহু মানুষ আসছেন শহরে। বিকেল থেকে শহরে পা ফেলার ঠাঁই নেই। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ার পরে জনস্রোতে শহর কার্যত ভেসে গেল। এক একটা ট্রেন আসছে, স্টেশন উপছে পড়ছে মানুষের ভিড়ে। ঘূর্ণির ছোট ছোট গলিতে মানুষের মাথাটুকু কেবল দেখা গিয়েছে। ভিড়ে অদৃশ্য শহরের রাস্তাঘাট। বড় বড় প্রতিমাগুলি যেখানে, সেই সব রাস্তায় ঢুকতে পারাই প্রথম পরীক্ষা। তারপরে সেখান থেকে বেরিয়ে আবার একটি প্রতিমা দর্শনের পরিক্রমায় কৃষ্ণনগর যেন এই দিন ফিরে পেয়ে গেল রাজকীয় গরিমার হৃত সেই দিনগুলি। এই দিন সারা রাত জেগে রইল কৃষ্ণনগর। দীপ নেভেনি শহরের বেশিরভাগ বাড়িতে।
শহরের পুরোনো বাসিন্দারা মনে করতে পারেন, রাজাদের আমলের পরেও জগদ্ধাত্রী পুজোয় শহরের গৌরবের দিনগুলি। তাঁদের স্মৃতিতে রয়েছে, এই পুজোকে ঘিরে একাধিক মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা। নানা স্থানীয় শিল্পকলার লালন-পালনের ভার নিত এই সব উৎসব। স্বদেশ রায় বলেন, “এক সময়ে জগদ্ধাত্রী পুজোয় খেউর ছিল বড় আকর্ষণ। শান্তিপুর থেকে খেউর শিল্পীদের আনা হত। কিন্তু রুচি বদলে গিয়েছে। খেউরও হারিয়ে গিয়েছে।” শহরের প্রাঙ্গণে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন ধরনের নাচেরও। চিকিৎসক স্বপন দাস যেমন কান পেতে থাকেন সানাইয়ের স্বরের খোঁজে। তিনি বলেন, “আগে মণ্ডপের পাশে বসত নহবৎ। থাকত ঢোলের বাদ্যি। সকাল থেকে নানা রাগে সানাইয়ের সেই স্বরের ওঠা-নামার সঙ্গেই যেন শহরে উৎসবের আবহ তৈরি হত।” এখন তার বদলে বাংলা গান এ বার অবশ্য বাজছে। অন্য বারের মতো কান ফাটানো গানের শব্দ এ বার নেই। বরং রয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। স্বপনবাবু বলেন, “আগে পাড়ার পুজোতে এত লোক হত না। পাড়ার লোকেরাই এক সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া করতাম। নিজেদের মধ্যে মেলামেশার একটা খুব ভাল সময় ছিল। এখন পুজোর জৌলুস হয়তো অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু ভিড়ের চোটে বোধহয় হারিয়ে গিয়েছে প্রাণ।” সদর মোড় এলাকার বাসিন্দা শিক্ষিকা পঞ্চশীলা মজুমদারের কথায়, “ছোটবেলায় দেখতাম পাড়ার লোকের আন্তরিকতা। এখন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আলো, প্রতিমা, মণ্ডপ তৈরি হয়। কিন্তু তা যেন নিজের জন্য নয়, সাজানোর জন্য।” কিন্তু শহর এখনও সেজে ওঠে। সেই উৎসবের সাজ ঢেকে দিয়েছে আগের কিছু অন্ধকারও। পঞ্চশীলা বলেন, “বিসর্জনের সময় এক সময় শোভাযাত্রা নিয়ে প্রচণ্ড গোলমাল হত। খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে। তাই অনেকেই তখন বেরোতে চাইতেন না। বিশেষ করে মহিলারা তো যেতেনই না। এখন কিন্তু সে সব নেই। মানুষ অনেক ভাল রয়েছেন।” এই শহরের মহিলারাই এক সময় শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে গোলমাল কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। চাষা পাড়ার বিখ্যাত পুজোর কাছাকাছিই থাকেন রিনা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “অনেক কিছুই হয়তো হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে বড় পাওয়া হল শান্তি। তা ছাড়া, এখন সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ উৎসবে যোগ দেন। আগে এতটা ছিল না।” সেই শান্তিই টেনে আনছে অন্য শহরের দর্শনার্থীদেরও। চন্দননগরের কাছাকাছিই থাকেন প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী অসিত দে। তিনি কিন্তু সস্ত্রীক এসেছেন কৃষ্ণনগরের পুজো দেখতে। বেহালা থেকে এসেছেন দীপঙ্কর সরকার। তিনি বললেন, “কৃষ্ণনগরের পুজোর টান তার রাজকীয় গরিমাতেই।” |