পুস্তক পরিচয় ২...
বাংলা গানে আধুনিকতার শুরু রবীন্দ্রনাথেই
বাংলা গানের পথচলা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকাল, ১৫০.০০
বীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা গান সম্পর্কে ‘আধুনিক বাংলা গান’ কথাটা চালু হলেও বাংলা গানে সর্বার্থে আধুনিকতার শুরু রবীন্দ্রনাথেই। আলোচ্য গ্রন্থে বাংলা গানের এক নিপুণ কারিগর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ ভাবেই রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করেন আধুনিক বাংলা গানের দিশারী হিসেবে। বাংলা গানের এই পথ-পরিক্রমায় রবীন্দ্রনাথই তাঁর প্রথম ও প্রধান সঙ্গী, সঙ্গে স্বনামধন্য আরও কয়েকজন শিল্পী-সুরকার। ঐতিহ্যের প্রতি নিষ্ঠ থেকেও কী ভাবে রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানকে আধুনিকতায় মণ্ডিত করেছেন তার বিশ্লেষণ আমাদের ঋদ্ধ করে। সংগীতসৃজনে রবীন্দ্রনাথ উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে নির্যাসটুকু নিয়ে গণ্ডি ভেঙে অন্য দিকে গিয়েছেন, এক রাগের সঙ্গে অবলীলায় মিশিয়ে দিয়েছেন অন্য রাগ, প্রায় সব পর্দাকেই সমান ভাবে ব্যবহার করেছেন গানের ভাব অনুযায়ী, লোকায়ত বাউল-কীর্তন অঙ্গকেও প্রয়োগ করেছেন রসবোধ মিশিয়ে অথচ স্রষ্টার স্বাতন্ত্র্য প্রশ্নাতীত। বিভিন্ন গানের উদাহরণ এবং রবীন্দ্রনাথের সংগীত-সম্পৃক্ত নানা অসামান্য উদ্ধৃতি সহকারে এ সব বিস্তারিত করেন লেখক। ‘এমন কোনও আধুনিক আঙ্গিক এমনকি যন্ত্রানুষঙ্গের আয়োজন পর্যন্ত নেই, যার ফরম্যাট রবীন্দ্রনাথ করে দিয়ে যাননি’ এমত মূল্যায়নের পাশাপাশি তিনি বলেন ‘আসুন আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি রবীন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্রসংগীতকে’। রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা গ্রন্থটি এখানে বার-বার উল্লিখিত। বলা দরকার, গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের সংগীত বিষয়ক প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকারের একটি সংকলন যা বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির উদ্যোগে এবং পুলিনবিহারী সেন-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবির প্রয়াণের পর, ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে।
গত শতকের ত্রিশের দশকে গান যখন এক বিভাজিত শিল্প, অর্থাৎ গীতিকার ও সুরকার আর একই ব্যক্তি নন, সে সময়ের এক উজ্জ্বল ফসল সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি অনুগত, অথচ কাব্যসংগীত নির্মাণে চূড়ান্ত মৌলিক। রাগের সাহায্য নিলেও তাঁর গান ‘রাগপ্রধান’ নয়। ‘পুষ্পচন্দ্রিকা’ রাগ তৈরি করে সুর দেওয়া ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’ গানটি উদাহরণ হিসেবে রেখে এমত বিশ্লেষণ সাধুবাদযোগ্য। পাশ্চাত্য সংগীতও অবহেলিত নয় হিমাংশুর কাছে অভিজিৎ বলেন সুপরিচিত ‘তোমারি পথপানে চাহি’-র কথা। এ-সূত্রে মনে পড়ে আরও গান ‘তোমারি বিরহে জানি গো’ কিংবা ‘ঝরানো পাতার পথে’।
১৯৪৯-এ বাংলা গানের দিক-ফেরানো সৃষ্টি ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ যাঁর, সেই সলিল চৌধুরী আবার একাধারে গীতিকার-সুরকার। কথা-সুর-যন্ত্রায়োজন সব দিক দিয়েই ব্যতিক্রমী সলিলকে চমকপ্রদ ভাবে চিত্রায়িত করেন শিষ্য অভিজিৎ। প্রাথমিক ভাবে গণসংগীত রচয়িতা সলিল কী ভাবে ‘বাণিজ্যিক গানেও এনেছেন রুচিবোধের সুস্থ চেতনায় প্রদীপ্ত জীবনবোধের ছোঁয়া’, কী ভাবেই বা সার্থক ভাবে প্রয়োগ করেছেন দেশি-বিদেশি সংগীত, যন্ত্রায়োজনকে নিয়ে গিয়েছেন অমোঘ উচ্চতায় তারই অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এ গ্রন্থে। ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’, ‘হেই সামালো’ প্রভৃতি গণসংগীত যাঁর রচনা, গণনাট্য সংঘের গণসংগীতের তালিকায় তিনিই অনুপস্থিত অভিজিতের এই খেদ খুবই সংগত।
শুধু সুর দিয়েছেন বা কথা লিখেছেন সলিলের এমন গান হাতে-গোনা। সুধীন দাশগুপ্ত কিন্তু গান লিখলেও সুরকার হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ইউরোপীয় সংগীতের প্রয়োগে সলিলের থেকে সুধীন কোথায় আলাদা, সে কথা বলে অভিজিৎ সুরকার সুধীনের বৈশিষ্ট্যগুলি মেলে ধরেন: মেলডি, বিভিন্ন সুরের বুদ্ধিদীপ্ত মিশেল, গ্রামীণ সংগীতের উপযুক্ত ব্যবহার, সুচিন্তিত যন্ত্রায়োজন। বলেন গীতিকার সুধীনেরও কথা।
সুধীনের মতো সংগীতশাস্ত্রে ততটা প্রশিক্ষিত হয়তো নন সুরকার নচিকেতা ঘোষ, কিন্তু তাঁর প্রয়োগ-সাফল্য প্রশ্নাতীত এ মত যথার্থ। অপ্রত্যাশিত স্বরবিন্যাসে ব্যতিক্রমী সলিলের উপরও নচিকেতাকে স্থান দেন অভিজিৎ। গানে ছন্দবিভাগ, মীড়, যন্ত্রের ব্যবহার সব দিকেই অন্য ও অনন্য নচিকেতার মৌলিকতা স্পষ্ট হয় এই আলোচনায়।
মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে এক পার্সি যন্ত্রবাদক মনেপ্রাণে কতটা বাঙালি হতে পেরেছিলেন, তার চেয়েও বড় কথা তাঁর শিল্পীসত্তা। সুরকার রূপেও ভি বালসারার কৃতিত্ব সুপ্রকাশিত অভিজিতের লেখায়।
‘সন্ন্যাসী রূপকার’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে অভিজিতের সঠিক মূল্যায়ন: ‘...গায়ক হিসেবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ, কিন্তু বাংলা চিত্রসংগীত জগতে তিনি সম্রাট সুরস্রষ্টা হিসেবে’। শিল্পী ও সুরকার দুই ভূমিকাতেই সার্থক হিসেবে অভিজিৎ হেমন্তর পাশেই রাখেন শ্যামল মিত্রকে। ‘সে দিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’ গানে গায়ক না সুরকার বড়, তা বলা কঠিন-- লেখকের এই অভিমত সমর্থনযোগ্য। ‘বোধিদীপ্ত শিল্পী’ শ্যামলের পাশে মান্না দে-র গানে আবার অন্য আমেজ। শিক্ষিত কণ্ঠ, আবেগ, নাটকীয়তা, সাংগীতিক অলংকরণ সব নিয়ে মান্না সব ধরনের গানেই সমান আকর্ষণীয়। তাঁর সুরও স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত।
অভিজিতের সুবিবেচনায় দেবব্রত বিশ্বাসও আধুনিক গানের এক স্মরণীয় রূপকার। শেষ নিবন্ধে অভিজিতের নিজের সুরকার হওয়ার কাহিনি।
আধুনিক বাংলা গান ও তার গতিপ্রকৃতির অনেকটাই ধরা পড়ে বইটিতে। তবে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ পীড়াদায়ক। লেখক সলিল সম্পর্কিত নিবন্ধে সুচিত্রা মিত্রের একটি রচনা সম্পূর্ণই দিয়েছেন (পৃ: ৭৩), কিন্তু উদ্ধৃতিচিহ্নহীন। ফলে লেখাটির শেষ কোথায় বোঝা যায় না। ‘পয়েন্ট’ কমিয়েও এটি আলাদা করা যেত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.