‘অস্তিত্ব সঙ্কটে’ পড়েই মাওবাদীরা দীর্ঘদিনের বাম-বিরোধী কর্মী জিতু সিংহকে খুন করেছে বলে মনে করছেন বলরামপুরের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বড় অংশ।
জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটির লাগাতার কর্মসূচি তো রয়েছেই। তার উপরে সম্প্রতি মাওবাদীদের প্রতিরোধের ডাক দিয়ে পোস্টারও পড়েছে। এলাকার যুবকেরা শান্তির দাবিতে স্বাধীনতা দিবসে মিছিল করেছেন। এক সময় মাওবাদীদের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ আদিবাসী মূলবাসী কমিটির কয়েক জন শীর্ষ নেতা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘদিন বাদে আজ, শনিবার কেরোয়া স্কুল ময়দানে জনসভা করবে তৃণমূল। তার উপরে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের লাগাতার কঠোর অবস্থান নেওয়া। সব মিলিয়ে বলরামপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মাওবাদীদের পক্ষে বড় একটা অনুকূল ছিল না বলেই মনে করছেন পুরুলিয়া জেলা পুলিশের একাংশ। |
এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে খানিকটা মরিয়া হয়েই জিতুবাবুর মতো গরিব চাষিকে খুন করে এলাকায় ফের সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে মাওবাদীরা, অভিমত জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক কর্তার। তাঁর ব্যাখ্যা, “একদা তাদের মুক্তাঞ্চল হিসাবে পরিচিত ঘাটবেড়ায় সম্ভবত কিছুটা অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখেই পড়ে গিয়েছিল মাওবাদীরা। অযোধ্যা স্কোয়াডের কয়েক জন সদস্যের ধরা পড়ে যাওয়াও তাদের খানিকটা ব্যাকফুটে রেখেছিল। তাই তারা ফের খুনের রাজনীতিতে ফিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নিজেদের পুরনো প্রভাব কায়েম করতে চাইছে।” জেলা পুলিশ সুপার সুনীলকুমার চৌধুরীও বলেন, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, সন্ত্রাস ছড়াতেই এই খুন করা হয়েছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, অকৃতদার জিতুবাবু বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন। দাওয়ায় শুয়েছিলেন বৃদ্ধা মা কুলদাদেবী। তাঁর কথায়, “হঠাৎ শুনতে পাই কে যেন ডাকছে, ‘জিতু খুড়া কোথায় আছ?’ উঠে দরজা খুলে দেখেন তিন-চার জন দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘরের দিকে দেখাই। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। তবে শুয়ে শুয়েই শুনতে পাই, ছেলে বলছে, সে এখন বাঁধে যাবে না।” ছেলের পরিচিত লোকেরা এসেছে ভেবে বৃদ্ধা খানিকটা নিশ্চিন্তেই ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে শোনেন, ছেলে খুন হয়েছেন। শুক্রবার ভোরে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি পুকুরের পাড়ে তাঁর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গলায় তখনও তার জড়ানো।
জিতুবাবুর এক ভাই বুধু সিংহ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওই বাড়িতেই অন্য পাশে থাকেন। অন্য ভাই অনন্ত এক সময় আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি কমিটির সংস্রব ত্যাগ করে তিনি ঝাড়খণ্ডে ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন।
অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে ঘাটবেড়ার অবস্থানগত কারণে এই গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকায় বরাবরই মাওবাদীদের আনাগোনা রয়েছে। বলরামপুর থানা এলাকায় গত তিন বছরে মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন অন্তত ২৪ জন সিপিএম নেতা-কর্মী। তার মধ্যে স্থানীয় ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েত এলাকাতেই ১২ জন সিপিএম কর্মীকে খুন করেছে মাওবাদীরা। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে এখানেই আদিবাসী মূলবাসী কমিটি গঠনের পর থেকে এই অঞ্চল কার্যত মাওবাদীদের ‘মুক্তাঞ্চল’ হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে গত বছর ২৯ জুলাই মাওবাদীদের হাতে নিহত হন তৃণমূলের ঘাটবেড়া-কেরোয়া অঞ্চল সভাপতি রাজেন মাহাতো।
এ বছর বিধানসভা ভোটের আগে আদিবাসী মূলবাসী কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অঘোর হেমব্রম তৃণমূলে যোগ দেন। পরিস্থিতির এক বড় বদল ঘটে তখন থেকেই। তাদের অন্যতম ‘গর্ভগৃহ’ বলরামপুরেই অঘোরবাবুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’। এ সবের জেরে এলাকায় মাওবাদী-তৃণমূল সংঘাত বাড়তে শুরু করে। গত মাসে বলরামপুরের একাধিক গ্রামে মোটরবাইক নিয়ে ‘মাওবাদী হঠাও অভিযান’ করে প্রতিরোধ কমিটি। তিন দিন পরে এলাকায় গ্রামবাসীদের সামনে হাতজোড় করে মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা এবং উন্নয়নে সামিল হওয়ার মৌখিক মুচলেকা দেন আদিবাসী মূলবাসী কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শম্ভু সিংহ সর্দার-সহ তিন জন। এই উদ্যোগের পিছনেও ছিলেন অঘোরবাবুরা। বলরামপুর স্টেশনে ‘নারী সম্মান রক্ষা কমিটি’-র পোস্টারে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয়।
জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক সন্তোষ মাহাতো মনে করেন, একদা জনগণের কমিটির সঙ্গে থাকা লোকজনকে নিয়ে সদ্যগঠিত প্রতিরোধ কমিটি যে ভাবে ঘাটবেড়া-কেরোয়া অঞ্চলে শক্তিবৃদ্ধি করছে এবং মাওবাদীদেরই ‘ঘাঁটিতে’ খুন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ও উন্নয়নের স্লোগাতে জনসভা ডেকেছে তৃণমূল, তাতে মাওবাদীরা বুঝেছিল ‘শিয়রে শমন’। সন্তোষবাবু বলেন, “মরিয়া হয়ে ওরা খুনের রাস্তাই বেছে নিয়েছে। জিতুবাবুর মতো নিরীহ মানুষকে না হলে ওরা খুন করবে কেন? সন্ত্রাস ছড়ানো ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?” তাঁর কথায়, “জিতুবাবু বয়স্ক মানুষ। অসুস্থ শরীর। তিনি তো প্রতিরোধ কমিটির কেউ ছিলেন না। তিনি দীর্ঘদিনের পরিচিত কংগ্রেস কর্মী। পরে তৃণমূলে গিয়েছিলেন।”
এ দিন ঘাটবেড়ায় দাঁড়িয়ে অঘোরবাবু বলেন, “মাওবাদীরা যে ভাবে ফের কুনের রাজনীতি শুরু করল, মানুষ তা প্রতিরোধ করবেনই। কারণ, সাধারণ মানুষ হিংসা চান না। শান্তি ও উন্নয়ন চান। শনিবার আমাদের সভাতেই সেটা স্পষ্ট হবে।” |