|
|
|
|
|
|
দক্ষিণ কলকাতা |
উধাও সেবা |
দুরারোগ্য নিকেতন |
দীক্ষা ভুঁইয়া |
নামেই হাসপাতাল। কিন্তু যাঁরা সেবা দেবেন, সেই নার্সদের অনেকেরই প্রয়োজনে দেখা মেলে না। রোগীদের অভিযোগ, অনেক ডাকাডাকির পরে তাঁদের দেখা মেলে। খাতায়-কলমে চিকিৎসকের সংখ্যা ঠিকঠাক দেখানো হলেও অধিকাংশ বিভাগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। একটু বাড়াবাড়ি হলেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্য হাসপাতাল বা বেসরকারি নার্সিংহোমে। পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও গার্ডেনরিচে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের সদর দফতরে অবস্থিত রেলের কেন্দ্রীয় হাসপাতালের দুর্দশা নিয়ে অভিযোগ বিভিন্ন রোগী ছাড়াও খোদ হাসপাতাল কর্মচারীদেরও।
হাসপাতালে নেই-এর সংখ্যা এতই বেশি যে প্রতি মুহূর্তে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় গার্ডেনরিচের রেল হাসপাতালে আসা রোগীদের।
যেমন, সেরিব্রাল অ্যাটাকে আক্রান্ত মাকে ভর্তি করানোর পর রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন মোমিনপুর রোডের বাসিন্দা মহম্মদ সেলিম। রীতিমতো অজ্ঞান অবস্থায় মা বিলকিস বেগমকে ভর্তি করান, কিন্তু মুশকিলে পড়লেন রাতের বেলায়। ওয়ার্ডে কোনও নার্স নেই। এক জন নার্স সামলাচ্ছেন তিন-তিনটি বিভাগ। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন মহম্মদ সেলিম, “রাতে মায়ের বাড়াবাড়ি হতে নার্সকে ডাকতে যাই। বেশ কয়েক বার ডাকার পরে নার্স আসেন। কিন্তু রীতিমতো বিরক্তি ভাব নিয়ে তিনি বললেন, ‘একা কত জন রোগীকে সামলাবো?’ শুধু তাই নয়, বাইরের যে আয়ারা থাকেন তাঁদের চেঁচামেচিতে সন্ধ্যার পর ওয়ার্ডে টেকা দায় হয়ে ওঠে। অসুস্থ রোগীদের কথা যেন কারও মনেই থাকে না!” |
|
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, কার্ডিওলজি বিভাগে বিশেষজ্ঞ মাত্র এক জন। রোগীর চাপ আর চিকিৎসকের অভাব পড়লে অন্য চিকিৎসকদের কার্ডিওলজি বিভাগের রোগী দেখতে হয়। হৃদ্যন্ত্রের কোনও রকম বড় চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার কোনওটাই এই হাসপাতালে হয় না। পাঠিয়ে দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট বেসরকারি হার্ট রিসার্চ সেন্টারে। আবার এক জন অস্থি-বিশেষজ্ঞ সামলাচ্ছেন অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগের সমস্ত রোগী। নেই স্নায়ুর কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও। চারটি অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে একটি খারাপ থাকা সত্ত্বেও কোনও রকমে তা জোর করে ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালের কর্মচারীদের জন্য রাখা বাস ব্যবহার হয় অ্যাম্বুল্যান্স হিসাবে।
মোট বারোটি ইউনিটের প্রতিটি বিভাগেই চিকিৎসকের সংখ্যা খাতায়-কলমে ঠিকঠাক দেখানো হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কার্যত নেই বললেই চলে। নেই পর্যাপ্ত নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। হাসপাতালে ঠিক কী আছে আর কী নেই বা থেকেও নেই তার হিসেব দিতে গিয়ে নাজেহাল হাসপাতালেরই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারীরা। আপৎকালীন বিভাগে রোগী বহনের জন্য যে একটিমাত্র ট্রলি আছে, সেটিও ভাঙা। অভিযোগ, আগে ইইজি হলেও বর্তমানে তা বন্ধ। সিটি স্ক্যান, এমআরআই হয় না। রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন বেসরকারি নার্সিংহোমে। অভিযোগ অনেক সময়ে সাধারণ ওষুধপত্রও মেলে না। রোগীর বাড়ির লোককে তা বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। শিশু বিভাগে শিশুদের পাশাপাশি ভর্তি করা হয় অন্য মহিলা রোগীদেরও। ফলে আলাদা করে শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কার্যত নেই বললেই চলে। বর্তমানে সদ্যোজাতদের জন্য কোনও রকমের ব্যবস্থাই নেই। নেই ইনকিউবেটর। প্রয়োজনে পাঠানো হয় অন্য বেসরকারি নার্সিংহোমে। অভিযোগ, রাতের বেলায় হাসপাতালের ওয়ার্ডে কোনও আরএমও থাকেন না। ‘অন কল’-এ থাকলেও এক শ্রেণির চিকিৎসক হাসপাতালে থাকেন না। কর্তব্যরত নার্সরা ফোন করে তাঁদের
ডেকে পাঠান। |
|
ডায়ালিসিস বা প্যাথোলজি বিভাগ রাতের বেলায় বন্ধ থাকে বলেও রোগী ও তাঁদের পরিজনদের অভিযোগ। বাইরে থেকে টেকনিসিয়ান নিয়ে এসে ডায়ালিসিস করানো হয়। তাঁদের অভিযোগ, নিজস্ব কর্মী না রেখে বেশি টাকা দিয়ে বাইরে থেকে টেকনিসিয়ান আনানো হয়। কোনও রোগী দুর্ঘটনায় মারা গেলে মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতালের নিজস্ব ডোমও নেই। বাইরে থেকে চুক্তিতে রাখা চতুর্থ শ্রেণির কমর্চারী বা আয়াদের দিয়েই মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়।
শুধু তাই নয়, মহিলা-মেডিসিন, মহিলা-কার্ডিও এবং শিশু বিভাগ মিলিয়ে যে ওয়ার্ড, সেখানেও দিনের বেলাতেই নার্স বলতে কখনও দু’জন, কখনও আবার এক জন। আর রাত্রে পুরো হাসপাতালে নার্স থাকেন মাত্র এক জন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে এক জন নিরাপত্তারক্ষীও চোখে পড়ে না।
অবশ্য হাসপাতালের এই বেহাল দশার কথা অস্বীকার করেছেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সৌমিত্র মজুমদার। তাঁর দাবি, এই হাসপাতাল দেশে রেলের অন্যান্য হাসপাতালের মধ্যে সেরা। তিনি বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালে এখান থেকে যাঁদের পাঠানো হয়, তাঁদের চিকিৎসার পুরো খরচই রেল বহন করে। সংশ্লিষ্ট রোগীকে কোনও খরচ করতে হয় না। অ্যাম্বুল্যান্স সমেত অন্যান্য পরিষেবাও ঠিকঠাকই আছে।”
পাশাপাশি হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল অফিসার (সিএমও) বিক্রম আদিত্যম সোয়াইন বলেন, “আমাদের এখানে মোট ৩৩ জন ডাক্তার আছেন। তবে কার্ডিও বিভাগে সঙ্কটজনক অবস্থায় কোনও রোগী এলে আমাদের সঙ্গে যুক্ত এক বেসরকারি হার্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দিই। অন্য বিভাগে আমাদের যা ডাক্তার দরকার সবই আছে। সদ্যোজাত বাচ্চাদের জন্য তৈরি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আনিয়ে নতুন বিভাগ খুব শীঘ্রই চালু করব। আর নার্স নিয়োগের পদ্ধতি যেহেতু সময়-সাপেক্ষ, তাই আমাদের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী ও নার্স রাখতে হয়।”
অ্যাম্বুল্যান্স এবং যন্ত্রপাতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দশ লাখ টাকার কম মূল্যের যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে জেনারেল ম্যানেজার মঞ্জুর করলেই হয়। কিন্তু তার থেকে বেশি দামের যন্ত্রপাতি কিনতে গেলে কেন্দ্রীয় রেলওয়ে বোর্ডের কাছে দরখাস্ত পাঠাতে হয়। সেই ফাইল মঞ্জুর হয়ে আসতে সময় লাগে। তবে এই মুহূর্তে ৩ কোটি ১৯ লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি কেনার বরাত দেওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই সেগুলি এসে যাবে।” |
|
|
|
|
|